মুফতি আহসান শরিফ, অতিথি লেখক : রমজান মাস, যাতে অবতীর্ণ হয়েছে কোরআন- মানুষের পথপ্রদর্শক, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী হিসেবে।... [সুরা বাকারা : ১৮৫]
রমজান আর কোরআন একে অপরের বন্ধু। সম্পর্ক তাদের গভীর। নিবিড়। রমজান ভালবাসে কোরআনকে। কোরআন ভালবাসে রমজানকে। যে ভালবাসা অমর। অবিচ্ছিন্ন। অটুট।
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এ মাসে খুব বেশি তেলাওয়াত করতেন। জিবরাঈল [আলাইহিস সালাম] নবীজীকে পুরো কোরআন শোনাতেন। নবীজী [সা.] শোনাতেন জিবরাঈল [আ.]কে। মাহে রমজানে যতো বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা হয়, অন্য মাসে তা হয় না। সকাল, সন্ধ্যা, দুপুর, বিকেল সারাক্ষণ কেউ না কেউ তেলাওয়াতে লিপ্ত। বছরের এগারো মাসে তেলাওয়াত করে না এমন ব্যক্তিও রমজানে তেলাওয়াতে ব্যস্ত থাকে। হাফেজদের কথা আলাদা। তাদের ওপর খতমে তারাবির চাপ থাকে। রমজানের আগেই শুরু হয় তাদের প্রস্তুতি। ঢাকার কজন বিখ্যাত হাফেজের তারাবির প্রস্তুতি জানতে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।
কুষ্টিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হাফেজ ড. এবিএম হিজবুল্লাহ [৫৫]। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির নাটেশ্বর গ্রামে তাঁর জন্ম। চাচা হাফেজ মাওলানা অজীহ উল্লাহর কাছে হিফজ শেষ করেন। হুফ্ফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনের পরীক্ষক তিনি। মদিনা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে তারাবি পড়িয়েছেন। ১৯৯০ সাল থেকে শেওড়া পাড়ার বাইতুশ শাকুর জামে মসজিদে তারাবি পড়াচ্ছেন। তাঁর কোরআন তেলাওয়াতের পদ্ধতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক সময় বসে বসে তেলাওয়াত করতাম। এখন আর সময় মিলে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সুন্নতে তেলাওয়াত করি। সফরে গাড়িতে বসে তেলাওয়াত করি। আর তারাবিতে তেলাওয়াতের হক আদায় করার চেষ্টা করি। তবে মুসুল্লি বুঝে না এতো দ্রুত পড়ি না। আবার মুসুল্লির কষ্ট হয় এতো ধীরেও পড়ি না।’
আমাদের দেশে হাফেজরা রাষ্ট্রীয় কোনো মর্যাদা পায় না এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সত্যিই বিষয়টি দুঃখজনক। হাফেজরা আল্লাহর কাছে সম্মানিত, তা আছে। তবে অন্যান্য মুসলিম দেশে হাফেজদের বিশেষ মূল্যায়ন করা হয়। তাদেরকে সার্টিফিকেট দেয়া হয়। কোনো চাকুরীতে জয়েন করলে তাদের তেলাওয়াতের জন্য সময় দেয়া হয়। যা আমাদের দেশেও হওয়া দরকার।’
প্রতি বছর যেভাবে হাফেজ তৈরি হচ্ছে, সে হারে মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে না। এতে হাফেজদের তারাবির জন্য মসজিদ মিলছে না?
এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাইতুল্লাহ শরিফ এবং মসজিদে নববীর অনুসরণে আমাদের দেশেও প্রতিটি মসজিদে তিনজন করে হাফেজ নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। এতে এ সঙ্কট অনেকটা কমবে।’
হুফ্ফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনের সহসম্পাদক ও মারকাজুল হুফ্ফাজের সাধারণ সম্পাদক হাফেজ মাওলানা মামুনুর রশীদ [৪২]। তাঁর জন্ম চাঁদপুর। তিনি হিফজ পড়েছেন হাফেজ্জি হুজুর [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] এর প্রতিষ্ঠিত নোয়াখালীর লধুয়া মাদ্রাসায়। লধুয়া মাদ্রাসা মসজিদ দিয়ে তার তারাবি পড়ানো শুরু। পরে মালিবাগ মাদ্রাসা মসজিদ, খিলগাঁও বাইতুত তাকওয়া মসজিদে কয়েক বছর এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে পড়াচ্ছেন নিউ স্কাটন রোড জামতলা জামে মসজিদে। তারাবির প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসার ক্লাস বন্ধ হওয়ার পর বিশেষভাবে প্রস্তুতি শুরু হয়।’ তারাবি কি উদ্দেশ্যে পড়ান? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তারাবি পড়াই। প্রত্যেকের উদ্দেশ্য এমন হওয়া উচিৎ। টাকার জন্য পড়ালে তো নিজেই সওয়াব পাবে না। মুসল্লিরা কিভাবে পাবে এর সওয়াব! আমার মসজিদে অন্যান্য নামাজের মতোই তারাবির নামাজ হয়। এর জন্য হাফেজ সাহেবকে সামনে বসিয়ে টাকা ওঠানো, একজন হাফেজের জন্য এটা বড়ই অপমানজনক। আমরা এমনটা করি না। হ্যাঁ, ব্যক্তিগতভাবে কারো হাদিয়া দেয়ার ইচ্ছে হলে তিনি হাফেজ সাহেবকে গোপনে দেবেন। এতে নিষেধ নেই।’
কেবল রমজানে মানুষের মাঝে হাফেজদের কদর থাকে। রমজানের পর হাফেজদের খবর নিতেও কাউকে দেখা দেখা যায় না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত কোরআনের ধারকরা সারা বছর কোরআন নিয়ে থাকে। আল্লাহর কাছে এবং মানুষের কাছেও তাদের কদর থাকে।’
হাফেজ মাওলানা মুফতি হিযবুল্লাহ [২৯]। পিতা মোহাম্মদ খলিলুর রহমান। মুন্সিগঞ্জ সিরাজদিখান গোবরদী গ্রামে তাঁর জন্ম। অসাধারণ মেধাবী হিযবুল্লাহ মাত্র নয় মাসে পূর্ণ কোরআন হিফজ করেন। গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় দেশব্যাপী হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। চট্টগ্রাম শহরে কদমতলী জামে মসজিদে এগারো বছর তারাবি পড়ান। এরপর ঢাকার শ্যামলী তারাবি পড়িয়েছেন। বর্তমান তাঁর প্রতিষ্ঠিত দারুল হিকমাহ আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার পাশেই দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এক মসজিদে তারাবি পড়ান। তারাবির ইন্টারভিউ এর নামে হাফেজদের হয়রানী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন হাফেজের জন্য পঞ্চাশজন হাফেজ ডাকা হয়। তা না হয় ডাকল। কিন্তু আত্মীয়দের মধ্যে আগেই নির্ধারণ করে রেখে কেবল আনুষ্ঠানিক ইন্টারভিউ এর কী প্রয়োজন? এভাবে হাফেজদের ভোগানোর কী উদ্দেশ্য! এগুলা বন্ধ হওয়া দরকার।’
হাফেজ নেসার আহমদ তানভীর [২২]। পিতা মোহাম্মদ হুমায়ুন পাটোয়ারী। শাহরাস্তি চাঁদপুরে তার জন্ম। তাঁর উস্তাদ বিখ্যাত হাফেজ ফয়জুর রহমান। নয় বছর ধরে তারাবি পড়াচ্ছেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠে মুগ্ধ সব মুসল্লি। হিফজ প্রতিযোগিতায় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছেন। সারাজীবন কোরআনের খেদমত করবেন এটা তাঁর ইচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সারা দেশের হাফেজরা ইচ্ছে করলে সেবামূলক কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। সবার ইচ্ছা থাকলে ব্যাপারটি খুব কঠিন হবে না। তিনি এবার মিরপুর ১৪ নম্বর একটি মসজিদে তারাবি পড়াবেন।
মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়ায় বাড়ি হাফেজ মাওলানা মুফতি হুমায়ুন সাঈদ এর। বাবা মোহাম্মদ জাকারিয়া শিকদার। চৌধুরী পাড়া মাদ্রাসায় হিফজ সমাপ্ত করেন। তার উস্তাদ হাফেজ বদরুজ্জামান। উত্তর ঘুরান সিপাহীবাগ জামে মসজিদে ১২ বছর তারাবি পড়িয়েছেন। গত তিন বছর ধরে আশুলিয়া কাঠগড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তারাবি পড়াচ্ছেন। পাশাপাশি কাঠগড়া ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। হাফেজদের কল্যাণ এবং সমাজ সেবার জন্য হাফেজদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। প্রতি বছর নির্ধারিত অংকে টাকা জমা করেন হাফেজরা। তিনি বলেন, ‘এতে হাফেজরা স্বাবলম্বী হবে এবং এর লভ্যাংশ দিয়ে গরিবের সাহায্য করা হবে। প্রত্যেক জেলায় এভাবে করতে পারেন হাফেজরা।’