মুজিবুর রহমান মুজিব : ময়মনসিংহ। বিভাগীয় শহর হিসেবে মানুষের কাছে নতুন পরিচিতি পেলেও এর শিক্ষা সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদানের কারণে সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কাছে অতিপরিচিত। বিশেষ করে জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা দীক্ষার দিক থেকে বহুকাল থেকেই ময়মনসিংহ বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষা নগরী হিসেবে খ্যাত। ঐতিহ্যবাহী এমন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
এর সংক্ষিপ্তরূপ বাকৃবি(bau)। প্রতিষ্ঠানটি তার উচ্চ সাফল্যের কারণে দেশের বাইরে থেকেও সুনাম অর্জন করেছে। এটি বাংলাদেশের কৃষি বিষয়ক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কৃষি বিজ্ঞানের সকল স্থলজ ও জলজ সবকিছুই এর আওতাভুক্ত। প্রতিষ্ঠানটির আচার্য : রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। উপাচার্য : প্র. ড. মো. আলী আকবর।
১৮ আগষ্ট ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আবৃবি। বর্তমান স্টাফ সংখ্যা ৫৩০। ছাত্র সংখ্যা ৪২৯৬(ছেলে ৩৩২৯ মেয়ে ৯৬৭)। ৪৮৫ হেক্টর (১২৫একর) জায়গা নিয়ে অবস্থিত এর পুরো আয়তন। ময়মনসিংহ শহর থেকে ৪ কি.মি দক্ষিণে পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬টি অনুষদের অধিনে ৪১টি শিক্ষাদানকারী বিভাগ রয়েছে। বর্তমান ৩৪টি বিভাগ পিএইচডি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সফলতা : বিশ্ববিদ্যালয়টি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শস্যের জাত চাষাবাদ কৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রসারে ব্যপক সাফল্য অজর্ন করেছে। তম্মধ্যে ।bau-65 এবং bau16 নামে দুটি আধুনিক ধানের জাত রয়েছে। সম্পদ ও সম্বল নামে দুটি উচ্চ ফলনশীল সরিষা রয়েছে।
উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে বীজবপন যন্ত্র। সার ছিটানো যন্ত্র। মাটি পরীক্ষার কীট। জীবসার ইত্যাদি।
আনন্দমোহন কলেজ
প্রায় শতবর্ষের ইতিহাস ঐতিহ্য ও নানা স্মৃতি নিয়ে আজো ময়মনসিংহের প্রাণকেন্দ্রে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এ প্রতিষ্ঠানটি। কলেজের সামনের দীর্ঘ বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ আর ঘনঘন গাছের সারির দৃশ্য সকলের উপভোগ করার মত। এখানে প্রতিদিন প্রায় শত শত জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীর আগমন হয় জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাতে। কলেজটির প্রথম ফটকেই সুন্দর করে লেখা আছে কয়েকটি আদর্শ নীতিবাক্য। যা দর্শনার্থীকে খুব সহজেই অনুপ্রাণিত করে।
কলেজটি স্থাপিত হয় ১৯০৮ সালে। বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ জাকির হোসেন। প্রশাসনিক স্টাফ ২০৭। ছাত্র সংখ্যাঃ প্রায় ৩২০০০। অবস্থান কলেজ রোড ময়মনসিংহ। জায়গা ১৫.২৮ একর। আবাসিক হলের সংখ্যা ৮ (ছেলে ৬টি মেয়ে ২টি।)
১৮৮৩ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক আনন্দ মোহন বসু ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৯০১ সালে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ময়ময়মনসিংহ সিটি কলেজ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯০৬ সালে আনন্দ মোহন স্যারের মৃত্যুর পর কলেজটি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তখন তৎকালিন বিভিন্ন রাজদরবারীরা কলেজটিকে আরো উন্নত সংস্কার ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার আশ্বাস দেন। তবে প্রত্যেকেই শর্ত দেন কলেজটি তার নিজের নামে হতে হবে। এনিয়ে পরস্পরে বিবাদ দেখা দেয়। এচরম মুহুর্ত তখন সামনে এগিয়ে আসেন আরেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারক ময়মনসিংহের প্রথম মুসলিম গ্রেজুয়েট ও উকিল আন্জুমানে ইসলামিয়ার সভাপতি মওলভী হামিদ উদ্দীন আহমাদ। তিনি নিজ টাকায় বর্তমান কলেজ রোডে ২৮ বিঘা জমি কিনে ঘোষণা দেন এখানেই এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হবে প্রথম প্রতিষ্ঠাতা আনন্দ মোহন বসুর নামে। এভাবেই সেখানে ১৯০৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজের যাত্রা শুরু হয়।
(কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আজ বিকৃত ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে শুধু আনন্দ মোহন বসুর নামই লিপিবদ্ধ রয়েছে। মুসলমানদের গৌরব বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জমিদাতা হামিদ উদ্দীন আহমদের নাম জ্ঞাণপাপিরা ইতিহাসের আস্তাকুরে নিক্ষেপ করে দিয়েছে৷ তার অবদানের কোন চিহ্নও আজ ইতিহাসে খোঁজে পাওয়া যায়না৷)
বর্তমানে কলেজটিতে ১৮টি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এছাড়া উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান,ব্যাবসা শিক্ষা, মানবিক তিনটি বিষয়ে ছাত্র ছাত্রী ভর্তি করা হয়। কলেজটিতে দেশি বিদেশি নতুন পুরাতন নানা বিষয়ে ৫০,০০০ বই নিয়ে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী রয়েছে৷
.
জামিয়া ইসলামিয়া মোমেনশাহী
বাংলাদেশে যেসব মহান পুরুষ ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁদের অন্যতম আল্লামা আশরাফ আলীর থানভী রহ. এর সোহবতধন্য প্রিয় শাগরেদ আল্লামা মানযুরুল হক রহ.। তিনি ময়মনসিংহের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মাদ্রাসা ও মসজিদ। ১৯৪২ সালে তিনিই ময়মনসিংহের প্রাণকেন্দ্র চরপাড়া মোড়ে ডাক্তার নেওয়াজ আলী সাহেবের দেওয়া প্রায় ৮০শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম নামের দীনি কওমি মাদরাসা। এটি পরবর্তীতে ১৯৫৬সালে জামিয়া ইসলামিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। যা আজো সগৌরবে ময়মনসিংহের প্রাণকেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
মাদ্রাসার বর্তমান মুহতামিম (অধ্যক্ষ) হলেন মাওলানা শওকত আলী। শিক্ষাসচিব মাওলানা সাঈদ আহমাদ। স্টাফ সংখ্যা ৫০জন। ছাত্র সংখ্যা ৮০০। নূরানি থেকে দাওরা ও ইফতা পর্যন্ত বিভাগ রয়েছে। মাদরাসার ভেতরে রয়েছে বিশাল গ্রন্থাগার। আছে সাহিত্য ও প্রকাশনা বিভাগসহ বক্তৃতা প্রশিক্ষণ, ইসলামি সাংস্কৃতি বিভাগ এবং দাওয়াতি কার্যক্রম৷
প্রতিষ্ঠানটির মূল ফটকের পাশেই শায়িত আছেন প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদীনের মুহতামিম যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা আল্লামা আতহার আলী রহঃ।
মুহিউস্সুন্নাহ মাওলানা মাহমুদুল হাসান। বহুগ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়াহ। মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়ব ও মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদসহ দেশ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত বহু ব্যাক্তিবর্গ এখান থেকে ইলমে দ্বীন হাসিল করেছেন।
.
মিফতাহুল জান্নাত মহিলা মাদ্রাসা
মুসলমান হিসেবে একজন পুরুষের জন্য যেমন দীনি জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য তেমনি মুসলমান হিসেবে একজন নারীর জন্যও সেই দীনি জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। কিন্তু সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে পুরুষদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দীনি ইলম অর্জনের ব্যবস্থা থাকলেও নারীদের জন্য তেমন ব্যাবস্থা ছিল না। বিশেষকরে ময়মনসিংহে। তাই ১৯৯৫ সনে ময়মনসিংহের বিশিষ্ট আলেম দীন আল্লামা আব্দুর রাহমান হাফেজ্জী হুজুরসহ শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম মুন্সিবাড়ির মুরব্বীদের সাথে নিয়ে ময়মনসিংহের গলগন্ডা ঐতিহ্যবাহী মুন্সিবাড়ি রোডে ‘মিফতাহুল জান্নাত মহিলা মাদ্রাসা’ নামে মেয়েদের জন্য একটি দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।
প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বাসা ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও বর্তমানে নিজস্ব জায়গায় রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সর্ববৃহত মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশের অধীনভুক্ত। দীর্ঘদিন যাবত এ শিক্ষাবোর্ডের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় মহিলা শাখায় কৃতিত্তের সাথে প্রথমস্থান অধিকার করে আসছে এ মাদ্রাসার ছাত্রীরা। এজন্যই এ প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের দেশসেরা মহিলা মাদ্রাসা বলা হয়। বর্তমান মাদ্রাসাটিতে ছাত্রী সংখ্যা প্রায় আটশ। মাদ্রাসাটিতে ছাত্রীদের জন্য দেশি বিদেশি বই এর সমৃদ্ধ এক কুতুবখানা (গ্রন্থাগার) রয়েছে।
.
ময়মনসিংহ জেলা স্কুল
এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গৌরবমণ্ডিত এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ১৮৫৩ খৃস্টাব্দের ৩ নভেম্বর ময়মনসিংহের বর্তমান জেলা স্কুল রোডে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান প্রধান শিক্ষক ইউনুছ ফারুকী। শুধু ছেলেদের ভর্তি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পাশের হার শতভাগ। ২০১৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনিতে ১৪৯জন পরীক্ষার্থীর মাঝে জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল ১৪৩জন জেএসসিতে ২৭৮ জন পরীক্ষার্থীর মাঝে জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল ২৬২ জন।
স্কুলটিতে ছাত্রদের জন্য রয়েছে একটি বিজ্ঞানাগার। একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। এক কম্পিউটার ল্যাবরেটরি ও একটি ব্যায়ামাগার। প্রতিবছর ছাত্রদের জন্য সাতার প্রতিযোগিতা ও নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম বাংলার বহু গুণী ব্যক্তি লেখাপড়া করেছেন। তাঁদের অন্যতম হলেন। জগদীশ চন্দ্র বসু। আনন্দ মোহন বসু। সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আবু সাইদ চৌধুরী। মাওলানা মানজুরুল হক রহ.।