মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ।। ২৩ পৌষ ১৪৩১ ।। ৭ রজব ১৪৪৬

শিরোনাম :

আল্লামা শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামার দৈনন্দিন কর্মসূচি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ইস্তাম্বুলে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামার বাসভবনে (২৬-২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪) লন্ডন প্রবাসী লেখক মাহফুয আহমদ

|| মাওলানা মাহফুয আহমদ || 

সাধারণত বড় কোনো আলেমের পরিবারের কোনো সদস্যকে দেখলে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করে থাকি; সেই আলেমের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার আশায়। এবার ইস্তাম্বুলের সফরে শেষদিনের রাত্রিবেলা ড. মুহী উদ্দীন আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ তাঁর ছেলে মুহাম্মাদকে পাঠালেন আমাদেরকে হোটেল থেকে তাদের ঘরে নেওয়ার জন্য।

মুহাম্মাদ যখন গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর সঙ্গে আমি গল্প জুড়লাম। বললাম, আল্লাহ তায়ালা আপনাদের পরিবারকে ইলমের জন্য আমাদের ক্বায়িদ (নেতা) হিসেবে কবুল করেছেন আর এখন গাড়িতেও আপনি আমাদের ক্বিয়াদাহ (ড্রাইভিং অর্থে) করছেন বা নেতৃত্ব দিচ্ছেন! মুহাম্মাদ হাসলেন!! তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার দাদার ইলমী কিতাবাদি তো আমরা নিয়মিত পাঠ করি, সমৃদ্ধ ও উপকৃত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। আচ্ছা, আপনি তো শায়খকে কাছে থেকে দেখছেন। শায়খের ব্যক্তিগত জীবন থেকে আমাদেরকে কিছু শোনালে খুশি হবো।

এবার মুহাম্মাদ বললেন, দাদা সম্পর্কে দুটি বিষয় আপনাদেরকে বলতে পারি। একটি হলো যে, দাদা কখনোই দুনিয়াবি বিষয়াদি নিয়ে কোনো কথা বলেন না। তাঁর সব কথাবার্তাই ইলম কেন্দ্রিক। এমনকি পানি চাইতে গেলেও কোনো বাক্য বলার চেয়ে তিনি হাতের ইশারায় তা বুঝিয়ে দেন। দ্বিতীয় বিষয় হলো, তাঁর বড় হিম্মত। এই বয়সেও তাঁর মাঝে আলস্যের কোনো ছাপ নেই।

ঘরে পৌঁছে এক প্রসঙ্গে ড. মুহী উদ্দীন আওয়ামা সাহেবকেও আমি একই প্রশ্ন করে বসলাম। মাশাআল্লাহ, সেই প্রশ্নের সূত্র ধরে শায়খ মুহী উদ্দীন আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ আপন পিতার পুরো দৈনন্দিন জীবনের রুটিন আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। আমাদের মতো তালিবুলইলম সাথীদের জন্য সেই আলোচনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তার সারাংশ উপস্থাপন করা হলো। (উল্লেখ্য যে, শায়খ মুহী উদ্দীন আওয়ামার কথাগুলো অডিও রেকর্ড করা হয়েছে। সেখান থেকে আমাদের একজন সফরসঙ্গী, মেধাবী আলেম, মাওলানা আবদুল্লাহ ফাহিম সাহেব সেটার অনুলিখন করেছেন। ইনশাআল্লাহ, সময়মতো সেটাও পাঠকদের সামনে পেশ করা হবে।)

ড. মুহী উদ্দীন আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ বলেন,

"আমি আমার জীবনে কখনো বাবাকে এক মিনিট সময়ও অপচয় করতে দেখিনি। তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত ব্যস্ততায় পূর্ণ থাকে। সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড এবং মিনিট নির্ধারিত পরিকল্পনামাফিক ব্যয়িত হয়।

এটি তাঁর দুই প্রধান শিক্ষকের (শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ এবং শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজ উদ্দীন) থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও সাহচর্যের প্রভাব। তিনি জ্ঞানার্জন এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে নিজেকে কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত রাখেন। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ ছিলেন গভীর গবেষণার জন্য সুপরিচিত, আর শায়খ আবদুল্লাহ ছিলেন ইলম, তাসাওউফ, ইবাদত ও তাহাজ্জুদের প্রতীক।

আমার বাবা এই দুই বিষয়—গভীর জ্ঞানচর্চা ও কঠোর আত্ম-পর্যালোচনা এবং পূর্ণ ইবাদতের—মধ্যে সমন্বয় করেছেন। এটা কীভাবে সম্ভব হয়? অবশ্যই নিজের স্বাস্থ্য ও সময়ের কুরবানী করেই তবে এমনটা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়।

তিনি সাধারণত রাত বারোটার পরে ঘুমাতে যান। যদিও এই বয়সে এটি একটি চ্যালেঞ্জ। কেন? এটি আমি পরে ব্যাখ্যা করব। তিনি প্রতিদিন ফজরের তিন ঘণ্টা আগেই জেগে ওঠেন। এর অর্থ, গ্রীষ্মকালে তিনি ঘুমাতে পারেন না, কারণ ফজরের আজান হয় প্রায় চারটায়। তখন তিনি রাতভর জাগ্রত থাকেন।

অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, শীতকালে যখন রাত লম্বা থাকে তখন তাহাজ্জুদের সময়ে জেগে ওঠার জন্য তিনি কোনো ধরনের এলার্ম ব্যবহার করেন না। বরং তিনি স্বীয় রবের কাছে এ মোনাজাত করেন:

يا رب، متى تريدني أيقظني

অর্থাৎ, "হে আমার রব! তুমি যখন চাও, আমাকে জাগিয়ে দিও।"

তাহিয়্যাতুল অজুর সুন্নত দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর তিনি কোরআন তিলাওয়াত শুরু করেন। প্রতিদিন তিনি তাহাজ্জুদের সময় ছয় পারা তিলাওয়াত করেন। এরপর তিনি তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবীহ, এবং বিভিন্ন দোয়া ও আওরাদ (বিশেষ আমল) সম্পাদন করেন, যা ফজরের আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। তাঁর নিয়মিত আমলের মধ্যে রিফাঈ তরিকতের আওরাদ রয়েছে, কারণ তিনি শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজ উদ্দীনের মাধ্যমে রিফাঈ তরিকার অনুসারী।

ফজরের নামাজ, দীর্ঘ তাসবীহ এবং সকাল-বেলার আওরাদ শেষ করার পর তিনি ঘুমান। শায়খের মূল ঘুম সাধারণত ফজরের পর হয় এবং এটি দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বা কখনো তিন ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে, কখনোই এর বেশি নয়। এরপর তিনি হালকা নাস্তা করে গবেষণা ও লেখালেখির জন্য অফিসে চলে যান। তিনি আমাদের বলতেন, "তালিবুল ইলম যেন খাবার খেতে বেশি সময় অপচয় না করে।" তাঁর গবেষণা ও লেখালেখি দুপুর পর্যন্ত চলে, সাধারণত চার ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময়।

এরপর তিনি ঘরে মধ্যাহ্নভোজ করেন এবং আধা ঘণ্টা বা সর্বাধিক এক ঘণ্টা 'কায়লুলাহ' করেন। সারা দিনে তাঁর ঘুমের মোট সময় পাঁচ ঘণ্টার বেশি নয়। তিনি বলেন, "তালিবুল ইলম কীভাবে পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমায়!"

এছাড়া বিকেলে পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য তিনি পুনরায় অফিসে যান এবং রাত আটটা পর্যন্ত সময় দেন। রাতের খাবার এবং ইশার নামাজের পর তিনি আবার বিশেষ আমল এবং দোয়া ও মোনাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাতে আমি (মুহী উদ্দীন) আমার সন্তানদের (মুহাম্মাদ ও যাহিদকে) নিয়ে বাবার পাশে বসি। তাঁর হাতে তাসবীহ থাকে। তখনও শুধুমাত্র ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন। দুনিয়াবি বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলে তিনি সময় নষ্ট করেন না। অবশ্য দুনিয়াবি এমন বিষয় যার সঙ্গে দ্বীন, ইলম ও মুসলিম উম্মাহর কোনো সম্পর্ক রয়েছে শায়খ সেসবের কথা শুনেন, খুঁজ নেন এবং প্রয়োজনমতো রাহনুমায়ি করে থাকেন। দরকার হলে সেগুলো সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করে থাকেন।

রাতে শায়খের মূল আমল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর হাজার হাজার (নির্ধারিত সংখ্যক) সালাত ও সালাম (দুরুদ) পাঠ করা, যা একটি স্বপ্নের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি পালন করেন। বস্তুত প্রায় ত্রিশ বছর আগে মদীনার একজন পূণ্যবান মানুষ স্বপ্নে দেখেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছেন যে মুহাম্মাদ আওয়ামার নিকট গিয়ে বলো আমার ওপর প্রাত্যহিক এই পরিমাণ দুরুদ পাঠ করতে। সেই দিন থেকে অদ্যাবধি শায়খ দুরুদের এই আমল জারি রেখেছেন। দুরুদ শেষ হতে হতে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। তারপর অজু করে ঘুমান।

এই হলো শায়খের দৈনন্দিন জীবন। কলম, কাগজ, কোরআন তিলাওয়াত এবং তাসবীহই তাঁর সঙ্গী।"

সুবহানাল্লাহ! আমাদের মতো জওয়ানরা শায়খ হাফিযাহুল্লাহর এমন কর্মব্যস্ত রুটিনের কথা শুনেই ক্লান্তি বোধ করছি! আমল তো পরের কথা!! আল্লাহ তায়ালা শায়খের হায়াত ও সিহহাতে ভরপুর বারাকাত নসিব করুন এবং আমাদেরকে শায়খ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক: উসতাযুল হাদীস, কুওয়াতুল ইসলাম ও মাদানী মাদরাসা, লন্ডন।

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ