|| মুফতি জুবায়ের বিন আব্দুল কুদ্দুস ||
কোরবানি একটি উৎসবমুখর ইবাদত। এই উৎসবের আনন্দ ও খুশি কেবল কোরবানিদাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কোরবানিকরা পশুর বিচরণে শহর-গ্রাম ও অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে যায় এক বিশেষ আনন্দের ঢেউ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর প্রতি বছর কোরবানি করেছেন। তিনি কখনও কোরবানিপরিত্যাগ করেননি; বরং কোরবানি পরিত্যাগকারীদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন। রাসুল সা. বেলেছন, عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়। (মুসনাদ আহমাদ- ৮২৭৩, ইবনে মাজাহ- ৩১২৩)
বর্ণিত হাদিস শরীফে সামর্থ্যবান বলে ওই ব্যক্তি কে বোঝানো হয়েছে, যার কাছে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং ঋণ ছাড়া নেসাব পরিমাণ সম্পদ আছে।
কোরবানির নেসাবের পরিমাণ হলো: স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৮৭ দশমিক ৪৫ গ্রাম) ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে ৫২ (৬১২ দশমিক ১৫ গ্রাম) ভরি। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো: এর মূল্য সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হতে হবে।
সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনও একটি যদি আলাদাভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানিওয়াজিব।
কোরবানির জন্য হিসাবযোগ্য পণ্য
কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য পণ্য হলো: টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না- এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাব।
প্রশ্ন হলো, কত টাকা থাকলে এ বছর কোরবানি ওয়াজিব হবে? তা জানতে হলে আগে রুপার মূল্য জেনে নিতে হবে।
আজ (২০ মে) মঙ্গলবার বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)-এর নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী, সনাতন রুপার মূল্য প্রতি ভরি ১৭২৬ টাকা। সুতরাং, সাড়ে ৫২ ভরি রূপার মূল্য আসছে ৯০ হাজার ৬১৫ টাকা। এই পরিমাণ টাকা বা মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ যার রয়েছে এবং যার মূল্য ৯০ হাজার ৬১৫ টাকা বা তার বেশি, তার ওপর এবছর কোরবানিওয়াজিব হবে।
সুতরাং কোরবানির দিনগুলোতে কারো কাছে ন্যূনতম হিসাবে যদি ৯০ হাজার ৬১৫ টাকা বা এর সমমূল্যের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকে, তাকে কোরবানিদিতে হবে। তবে কোরবানিযেহেতু ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সময়ের মধ্যে ওয়াজিব হয়, সে সময়ের দাম হিসাব করতে হবে। কারণ ততদিনে রুপার দাম কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। কোরবানিওয়াজিব হবে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সাড়ে ৫২ ভরি রুপার যে দাম থাকবে, তার ওপর ভিত্তি করে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯৬,আলমুহীতুল বুরহানি: ৮/৪৫৫)
কী পরিমাণ ঋণ থাকলে কোরবানি ওয়াজিব নয়?
যদি জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের পর তার সম্পদ নেসাব পরিমাণ কমে যায়, তবে তার ওপর কোরবানিওয়াজিব হবে না। তবে, যে সকল ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়ান, তাদের জন্য এই ঋণ বাদ দেয়া হবে না। সে ক্ষেত্রে, ঋণ থাকা সত্ত্বেও কোরবানিকরতে হবে। অন্যদিকে, যারা মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ঋণ নিয়েছেন, কেবল তাদের ঋণ নেসাবের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া যাবে।
মৌলিক প্রয়োজন বলতে কী বুঝায়?
মৌলিক প্রয়োজন বলতে সেই সমস্ত জিনিসগুলোকে বোঝানো হয়, যা ছাড়া মানুষের জীবন অচল হয়ে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে—বাসস্থানের বাড়ি, চলাচলের গাড়ি, উপার্জনের আসবাবপত্র, ব্যবহারের কাপড়-চোপড়, এবং কাজের লোক ইত্যাদি। একইভাবে, কোনো নারী যদি তার স্বামী কর্তৃক যথাযথ ভরণপোষণ পান এবং তার মালিকানায় জমি থাকে, তবে সেটাও মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য হবে।
কোরবানি এবং যাকাতের নেসাবের পার্থক্য
কোরবানিও যাকাতের নেসাবের মধ্যে মৌলিকভাবে দুটি পার্থক্য রয়েছে:
১. যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক, কিন্তু কোরবানিওয়াজিব হওয়ার জন্য এক বছর থাকতে হবে না; বরং জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত সেই পরিমাণ সম্পদ থাকা যথেষ্ট।
২. যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য স্বর্ণ, রূপা, টাকা-পয়সা এবং ব্যবসার পণ্য হতে হয়, কিন্তু কোরবানিওয়াজিব হওয়ার জন্য মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব সম্পদ নেসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন—জমি, বাড়ি, গাড়ি, পোশাক, সৌন্দর্য বর্ধনকারী আসবাবপত্র ইত্যাদি। যদি এসবের মূল্য নেসাব পরিমাণ হয়, তবে তার ওপর কোরবানিওয়াজিব হবে।
(তথ্যসূত্র: বাদায়ে সানায়ে ৫/৬৪, মুলতাকাল আবহুর পৃ ৩৩৪, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ৫/২৯২, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২১, আল ফাতাওয়াল বাযযাযিয়াহ ৬/২৮৭, ফাতাওয়ায়ে ফাকিহুল মিল্লাত ১১/১৮৮-২০০)
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ ঢাকা
খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ
পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ
এমএইচ/