সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ‘সান্ডা’ বা ‘দব’ খাওয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। ইসলামিক শরিয়াহ অনুযায়ী, এই ধরনের প্রাণী ভক্ষণ করা হালাল কি না, তা নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে।
সান্ডা, দব এবং গুইসাপ কী?
সান্ডা, দব এবং গুইসাপ দেখতে কিছুটা মিল থাকলেও আসলে ভিন্ন প্রাণী।
সান্ডা: এটি বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। সান্ডা মূলত উভচর এবং সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। এটি দেখতে Monitor Lizard বা গুইসাপের মতো। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, সান্ডা খাওয়া হারাম, কারণ এটি সরীসৃপ জাতের অন্তর্ভুক্ত। আরব অঞ্চলে সান্ডা পাওয়া যায় না এবং তারা এটি খায় ও না।
মরুভূমির দব: এটি মূলত আরবের মরুভূমিতে পাওয়া যায় এবং এটি Spiny-tailed Lizard বা Uromastyx নামে পরিচিত। সাহাবিগণ এটি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর উপস্থিতিতেই খেতেন। রাসুলুল্লাহ (স.) নিজে এটি খাননি, তবে সাহাবিদের খেতে নিষেধও করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমার এলাকায় ছিল না, তাই আমি এর প্রতি আগ্রহ বোধ করি না। কিন্তু তোমরা খেতে পারো, কারণ এটি হারাম করা হয়নি।’ (সহিহ বুখারি: ৫৩৯১, সহিহ মুসলিম: ৪৯৪৪)। অধিকাংশ ইসলামি স্কলারদের মতে এটি হালাল, তবে হানাফি মাজহাবে এটি খাওয়া হারাম। আরবরা সাধারণত এই দব খেয়ে থাকে।
গুইসাপ: এটি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। ইংরেজিতে একে Monitor Lizard বলা হয়। এটি জল এবং স্থল উভয় জায়গায় বসবাস করে এবং সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী হওয়ায় ইসলামে এটি হারাম। হানাফি মাজহাবে এটি খাওয়া স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।
কোরআন ও হাদিসের দলিল
কোরআনে বলা হয়েছে: ‘তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার এবং তা আহার হালাল করা হয়েছে।’ (সূরা আল-মায়েদা: ৯৬)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন: ‘সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং এর মৃত প্রাণী হালাল।’ (তিরমিজি: ৬৯, আবু দাউদ: ৮৩)
ইসলামি ফিকহবিদদের মতামত
হানাফি মাজহাব: হানাফি মাজহাবের অনুসারীরা শুধুমাত্র মাছজাতীয় প্রাণীকে হালাল মনে করেন। সরীসৃপ বা উভচর প্রাণী, যেমন দব (Spiny-tailed Lizard) এবং গুইসাপ খাওয়া জায়েজ নয়।
দলিল:
১. ‘মাছ ব্যতীত জলচর বা উভচর সরীসৃপ যেমন: কচ্ছপ, গুইসাপ, সাপ এবং দব—এগুলো খাওয়া হানাফি মাজহাবে হারাম।’ (আল-হিদায়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৫৭)
২. ‘শুধু সামুদ্রিক মাছ হালাল; জলজ ও স্থলজ মিলিত প্রাণী, যেমন দব (Spiny-tailed Lizard), গুইসাপ ইত্যাদি খাওয়া হারাম।’ (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৯০)
৩. ‘দব প্রাণীটি সরীসৃপ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, আর হানাফি মাজহাবে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী খাওয়া হারাম হিসেবে গণ্য করা হয়।’ (আল-মাবসুত, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৩১)
৪. ‘প্রকৃতিগতভাবে অপবিত্র বা অরুচিকর সকল প্রাণী হারাম, যেমন: সাপ, গুইসাপ, দব ইত্যাদি।’ (বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৮০)
মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব: এই তিন মাজহাবে সামুদ্রিক সকল প্রাণী হালাল হলেও, সাপ ও উভচর প্রাণীকে হালাল মনে করা হয় না। তবে, দব খাওয়া জায়েজ। হাম্বলি মাজহাবেও দব খাওয়া হালাল বলে গণ্য করা হয়। (মুগনি আল-মুহতাজ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৯১; আল-মুদাওয়ানা, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪৬)
সাণ্ডা বা দব খাওয়ার ফতোয়া
শরিয়াহ পর্যালোচনা অনুযায়ী, সান্ডা এবং দব সরীসৃপ হওয়ায় ইসলামে তা খাওয়া নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত সহিহ বুখারি অনুবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দব রাসুলুল্লাহ (স.)-এর উপস্থিতিতে সাহাবীগণ খেতেন। তিনি নিজে খাননি, তবে সাহাবিদের খেতে নিষেধ করেননি। ফাউন্ডেশনের দৃষ্টিতে, রাসুলুল্লাহ (স.) হারাম বলেননি, তাই আরব অঞ্চলে এটি জায়েজ বলে গণ্য।
দারুল ইফতা বাংলাদেশ-এর ফতোয়া নং ৩২১/২০২৪-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দব খাওয়া হানাফি মাজহাবে মাকরুহ, তবে হারাম নয়। অন্যান্য মাজহাবে এটি হালাল। দারুল ইফতা আরও বলে, যেহেতু এটি রাসুলুল্লাহ (স.) নিষেধ করেননি, তাই শরিয়াহ মতে সম্পূর্ণ হারাম বলা যাবে না।’
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য শরিয়াহ নির্দেশিত খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই, সান্ডা ও গুইসাপ খাওয়া থেকে বিরত থাকা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি। আর দব যাদের খাওয়ার অভ্যাস আছে, তারা খাবেন, আর যাদের মাজহাবে অনুত্তম, তারা তা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
এনএইচ/