শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

মাওলানা ইসহাক ফরিদী: ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন ও কয়েকটি টুকরো স্মৃতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

|| মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ||

মাওলানা ইসহাক ফরিদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। আমাদের এক সিনিয়র সাথী। কর্মপ্রেরণায় উজ্জীবিত এক নিরলস পরিশ্রমী উচ্ছল সাথী। জগত সংসারের চিরাচরিত আসা যাওয়ার নীতির আওতায় বিগত ০৫/০৬/০৫ইং তারিখে আমাদের থেকে বিদায় নেয়া এক মরহুম সাথী। আল্লাহ পাকের মেহেরবানি ও রহমতে আমরা আশা পোষণ করি জান্নাতেও আমরা হয়ে থাকব তাঁর সাথী। আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বান্তকরণে দোয়া-তিনি তাঁর জন্য জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চতর মাকামের ফায়সালা করুন। আমীন!

মাওলানা ইসহাক ফরিদী রাহিমাহুল্লাহ-এর ইন্তেকালের পর তাঁর জীবন স্মৃতি নিয়ে আলোচনা সভা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে পারস্পরিক মতবিনিময় ও আলাপচারিতায় তাঁর প্রতি ভক্তি ও মুগ্ধতার অভিব্যক্তি ঘটেছে। এখন তাঁর স্মৃতি ও জীবনাদর্শকে কাগজে কলমে ধরে রাখা ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দেয়ার মানসে তাঁর নামে স্মারক প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এসব কিছুই তাঁর প্রাপ্য মূল্যায়ন।

ব্যক্তিত্বের যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া চাই। ব্যক্তিত্বের যথাযথ মূল্যায়ন হলে অনুরূপ ব্যক্তিত্বের বিকাশমানতা উৎসাহিত হয়। কারও ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন হলে সমাজ সভ্যদের সামনে সেই ব্যক্তিত্ব আদর্শ ও মূল্যবোধের বাস্তবরূপ সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়, যা তাদের মধ্যে অনুরূপ কাঠামোতে নিজেদেরকে ঢেলে সাজানোর উদ্দীপনাকে জাগ্রত করে। পক্ষান্তরে ব্যক্তির গুণাগুণ, আদর্শ ও যোগ্যতার মূল্যায়ন না হলে একদিকে খোদার নেয়ামতের না শুকরিও হয়, আবার পরবর্তী প্রজন্ম আদর্শ ও মূল্যবোধের বাস্তবরূপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ এবং তার প্রতি মনোযোগ ও উৎসাহ- উদ্দীপনা সৃষ্টির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তাই ব্যক্তিত্বের মূল্যায়নের নিমিত্তে এসব আলোচনা- পর্যালোচনা, স্মৃতিমন্থন ও লেখালেখি প্রশংসার্হ বৈ কি।

কিন্তু আজ লিখতে বসে অতীতে মাঝে মধ্যেই আমি যে কথাটি ভাবি, সেই ভাবনাটিই বারবার মনের ভিতর মন্থিত হচ্ছে। ভাবনাটি হল-ব্যক্তির মূল্যায়ন অবশ্যই হওয়া চাই।

কিন্তু তা কি শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুর পরই? তাঁর জীবদ্দশায় কি তাঁর মূল্যায়ন হতে পারে না? যদি পারে তাহলে কেন আমরা ব্যক্তির জীবদ্দশায় তাঁর মূল্যায়নে এত অনগ্রসর থাকি? দু'একটি ব্যতিক্রম বাদে সাধারণভাবে কেন আমরা জীবদ্দশায় কারও মূল্যায়ন করতে জানি না? জীবদ্দশায় কারও গুণাগুণ ও যোগ্যতা মূল্যায়িত হলে তাতে কি তার ব্যক্তিত্বে ও গুণাবলী আরও উৎসাহিত হয় না? তাতে কি তার অনুপ্রাণিত কর্ম ও আদর্শ আরও বেশি প্রস্ফুঠিত হয় না? তাতে কি জাতি হাতে কলমে আরও বেশি উপকৃত হতে পারে না?

কিন্তু আমরা যেন কারও জীবদ্দশায় শুধু তাকে সমালোচনা এবং অবহেলাই উপহার দিতে জানি আর মৃত্যুর পরই কেবল তার মূল্যায়ন করতে পারি।

আমৃত্য যাকে আমরা শুধু সমালোচনা আর অবহেলা দিয়ে নিবারিত করে থাকি, মৃত্যুর পরই তাকে প্রশংসা ও ভক্তির ডালি দিয়ে বরণ করতে শুরু করি। আমাদের আচরিত এই নীতি থেকে অনুমিত হয় যে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার জীবনে ভাল কোন দিক ছিল না, যা ছিল শুধুই দোষ আর দোষ, মৃত্যুর সাথে সাথেই যেন সব দোষ গুণে রুপান্তরিত হয়ে গেল! কি অদ্ভুত আমাদের নীতি! এ নীতি বিদ্যমান ব্যক্তিত্বের বিকাশমানতাকে উৎসাহিত না করার নীতি। এ নীতি জাতিকে বঞ্চিত করার নীতি। তদুপরী এ নীতি আত্ম-সংকীর্ণতারও নীতি, যদি তার অনুশীলন এ কারণে হয় যে, অন্যকে মূল্যায়িত করলে নিজের হিস্সা কমে যাবে। এ নীতি থেকে আমরা কি উঠে আসতে পারি না?

মাওলানা ইসহাক ফরিদী রাহিমাহুল্লাহ সম্বন্ধে আমি তেমন দীর্ঘ তথ্যভিক্তিক কোন লেখনী পেশ করতে যাচ্ছি না। তাঁর সাথে আমার ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করব মাত্র। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা থেকেই আমি তাঁর ব্যক্তিত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য প্রতীয়মান করার চেষ্টা করব। মাওলানা ইসহাক ফরিদীর সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৮৩ সালে, যখন আমি মালিবাগ মাদরাসায় হেদায়া জামায়াতে (সানুবী-২বর্ষে) ভর্তি হই তখন থেকে। তখন তিনি দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর ছাত্র। দাওরায়ে হাদিস থেকে ফারেগ হওয়ার পর তিনি কুমিল্লা কাসিমুল উলুম মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে খেদমতে রত হন।

আমার জানামতে এ সময়েই তাঁর নিয়মিত লেখনী জগতে পদার্পন ঘটে। ইতিপূর্বে তার নিয়মতান্ত্রিক বাংলা সাহিত্য চর্চা ও লেখনী অনুশীলন ছিল না বললেই চলে। তবুও তিনি তাঁর চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী হিম্মত করেই এ জগতে নেমে পড়েন। আর সেই হিম্মতের ফলশ্রুতিতে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় জাতির জন্য বেশ কিছু সংখ্যক ইসলামি রচনা উপহার দিয়ে যেতে সক্ষম হন। সত্যিই সকল ক্ষেত্রে মরহুম মাওলানা ইসহাকের হিম্মত ও নিরলস সাধনা ছিল আমাদের সাথী সঙ্গীদের মধ্যে অনন্য মহিমায় মন্ডিত। কোন কাজে তিনি হিম্মত হারাতেন না। হিম্মত বা সাহস নষ্ট হতে পারে, সায়মা এমন কোন কিছু করতেও তিনি সম্মত ছিলেন না।

তাঁর একটা ক্ষুদ্র উক্তি বর্ণনা করছি। ছাত্র জীবনের পর অনেকের মত আমাকেও তিনি 'মাওলানা' বলে সম্বোধন করতেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন মাওলানা! স্বাস্থ্য খুব ভাল নয়, তবুও ডাক্তারের কাছে যাই না শুধু এই ভয়ে যে, গেলে আবার বলে বসে কি না আপনার কিডনী নষ্ট, কিংবা ভাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে বা লান্স খারাপ হয়ে গেছে। এগুলো শুনলে খামোখা জীবনের যতটুকু অবশিষ্ট আছে তাও টেনশনে যাবে, কাজের সাহস হারিয়ে বসব। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করেই চালিয়ে যাচ্ছি।

আমার জানামতে তাঁর রচিত প্রথম বই হল "কুরবানীঃ ইতিহাস ও মাসায়েল"। কুমিল্লা কাসিমুল উলুম মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে খেদমতে রত থাকাকালীন তিনি এ বইখানা রচনা করেন। এ বইটি রচনা করার পর হঠাৎ একদিন রাতে তিনি মালিবাগ মাদরাসায় আমার কাছে হাজির। আমি তখনও মালিবাগ মাদরাসার ছাত্র। বইয়ের পান্ডুলিপিখানা বের করে বললেন হেমায়েত ভাই! লেখাজোখাতো কিছুই জানি না, তারপরও লিখেছি, আপনি দেখে একটু ঠিকঠাক করে দিন। আমার বয়োজ্যেষ্ঠ হয়েও তিনি আমাকে দিয়ে তাঁর বই সংশোধন করাতে চান! তিনি শরম বোধ না করলেও আমি ঠিকই শরম বোধ করলাম।

একজন জুনিয়র ছাত্রভাইয়ের কাছে নিঃসংকোচে তাঁর এমন কথা বলতে পারার মত নিরহংকার মানসিকতা শুধু এ ঘটনাতেই নয় তাঁর জীবনের আরও বহু ঘটনায় তা প্রকাশ পেয়েছে। আর যা শুধু আমাকে নয় আরও অনেককে মুগ্ধ করেছে। যাহোক তাঁর পান্ডুলিপি সংশোধন নয় বরং কিছুটা দেখে গোটা আংগিক পরিবর্তন করে ফেলার পরামর্শ দিলাম। কি অদ্ভুত ব্যাপার, তিনি সেই পরামর্শ মুতাবিক অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আবার পুরো পান্ডুলিপি নতুন করে সাজিয়ে আনলেন। এরূপ নিরলস পরিশ্রমই তাঁকে জীবনের অল্প সময়ে অনেক অগ্রসরতা দান করেছে। আর একটি ক্ষুদ্র ঘটনা বলেই আমার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণের ইতি টানছি।

২০০৩ ইংরেজি সনে আমি যখন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার পক্ষ থেকে প্রদত্ত দায়িত্ব মুতাবিক আমার "ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ" গ্রন্থখানা রচনার কাজ করছিলাম, একদিন মাওলানা ইসহাক ফরিদীর সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন মাওলানা! কোন কোন গ্রন্থের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছেন। তাঁকে সহযোগী গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা শোনালাম।

তিনি আরও তিন চারখানা গ্রন্থের নাম উল্লেখ পূর্বক বললেন এগুলি থেকে অমুক বিষয়ের সহযোগিতা নিতে পারেন এবং বললেন এ গ্রন্থগুলি আমার কাছে আছে, নিয়ে যাবেন। এতে করে সমাজে গ্রন্থ নিয়ে ফেরত না দেয়ার ব্যাপক প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় অন্যকে নিজের গ্রন্থ দিতে চাওয়ার মত উদারতা তো অনুভব করলামই, তদুপরি এতে করে তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতা আরও বৃদ্ধি পেল এই চিন্তা করে যে, আর অনেকের মত তিনি সমকালীন সাথী সঙ্গীদের অগ্রসরতায় ঈর্ষান্বিত নন বরং সে ব্যাপারে আগ্রহান্বিত-এই পরিচয়ই তিনি দিলেন।

তিনি সে সময় আমাকে আরও পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, আকায়েদের দিকগুলি লিখতে গিয়ে উলামায়ে দেওবন্দের কিছু আকিদা নিয়ে রেজবী বিদ'আতীদের যে অপব্যাখ্যা এবং ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে সেগুলি স্পষ্ট হওয়া চাই। যাতে উলামায়ে দেওবন্দের আকায়েদ সম্পর্কে বিভ্রান্তির নিরসন হতে পারে। আমার তখন মনে হয়েছিল উলামায়ে দেওবন্দের মাসলাক ও মাশরাব সম্পর্কে তাঁর মনের দৃঢ় ভক্তির চেতনা সর্বদাই জাগ্রত থাকে। আমি বহুবার বহু স্থানে তাঁকে "তারিখে দারুল উলুম" গ্রন্থের ভূমিকায় কারী মুহাম্মদ তাইয়্যেব সাহেব রাহিমাহুল্লাহ কৃর্তক লিখিত উলামায়ে দেওবন্দের মাসলাক ও মাশরাব সম্পর্কিত নিম্মোক্ত দীর্ঘ ইবারত গড়গড় করে মুখস্থ আবৃত্তি করতে শুনেছি।

প্রয়োজনীয় স্থানে এভাবে বহু কিতাব ও বহু রেসালার অনেক ইবারত তিনি গড়গড় করে মুখস্থ আবৃত্তি করে যেতেন। যেমন বিষয় ভিত্তিক বহু হাদিস এবং কুরআনের আয়াতসমূহ সংশ্লিষ্ট স্থানে তাৎক্ষণিকভাবে পেশ করতে সু-সক্ষম ছিলেন। আমাদের সাথী সঙ্গীদের মধ্যে এর নজির আর দ্বিতীয়টি নেই।

-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ