তাওহীদ আদনান ইয়াকুব
২০১৮ সালে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) সনদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামিক স্টাডিজ বা আরবি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান দেওয়া হয়। অনেকেই এটিকে কওমি শিক্ষাব্যবস্থার বড় অর্জন বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, বিশেষ করে একাডেমিক এবং পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ, যেখানে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাডেমিকভাবে মাস্টার্স পর্যায়ে পৌঁছাতে বহুস্তরীয় মূল্যায়ন ও সময় লাগে, সেখানে দাওরায়ে হাদিসের সনদে সরাসরি মাস্টার্সের স্বীকৃতি অনেকাংশেই শিক্ষাগত মাপকাঠির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
১. একাডেমিক কাঠামোর অমিল
সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পূর্বশর্ত হলো:
১০ বছর স্কুলিং (এসএসসি),
২ বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি),
৩-৪ বছর স্নাতক (অনার্স/পাস),
অতঃপর ১-২ বছর স্নাতকোত্তর।
অন্যদিকে, কওমি ধারায়:
৩-৪ বছর নুরানি ও নাজেরা। (হিফজ বিভাগ একটি আলাদা বিভাগ। দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়ালেখার সাথে সম্পৃক্ত নয় বললেই চলে)
১০-১১ বছর আলিমিয়্যা (যার মধ্যে উচ্চতর শ্রেণিতে হাদিসের পাঠ অন্তর্ভুক্ত)
কোথাও কোথাও এই সময় আরো সংক্ষেপিত। সর্বমোট ১০ বছর বা ১২ বছর।
এরপরও দাওরায়ে হাদিসকে সরাসরি মাস্টার্সের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, যা একাডেমিক ধারাবাহিকতার সাথে সাংঘর্ষিক।
২. গবেষণাভিত্তিক চর্চার অভাব
মাস্টার্স পর্যায়ের মূল বৈশিষ্ট্য হলো গবেষণা দক্ষতা, গবেষণা পদ্ধতি, গবেষণাপত্র রচনা এবং বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা অর্জন। অথচ কওমি মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত:
গবেষণামূলক কাজের কোনো চর্চা নেই।
থিসিস/ডিসার্টেশনের প্রচলন নেই।
আধুনিক গবেষণার পদ্ধতি (Research Methodology, Citation, Critical Thinking) শেখানো হয় না।
মাস্টার্স শিক্ষাস্তরের বিষয় ভিন্ন ভিন্ন হয়। সকলেই যার যার পছন্দ মতো সাবজেক্ট নিতে পারে। অথচ কওমি মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিসে সাবজেক্ট একটাই তথা হাদিস।
ফলে একাডেমিকভাবে এটি ‘মাস্টার্স’ সমমান দাবি করা বাস্তবতাবিবর্জিত।
৩. বিষয়ভিত্তিক গভীরতার প্রশ্ন
মাস্টার্স ডিগ্রি মানে নির্দিষ্ট বিষয়ের গভীর জ্ঞান। কিন্তু দাওরায়ে হাদিসে হাদিসশাস্ত্রই মূল কেন্দ্রবিন্দু, অথচ মাস্টার্স সমমান দেওয়া হয়েছে ইসলামিক স্টাডিজ-এ, যা বিষয়ভিত্তিক এক ধরনের "equivalence mismatch"। এই অস্বাভাবিক মিলন যেমন শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বলতা তৈরি করে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি ছড়ায়।
৪. চাকরির বাজারে বিভ্রান্তি ও বৈষম্য
সরকারি নিয়োগে মাস্টার্স সমমান নিয়ে কওমি সনদধারীরা যখন আবেদনের সুযোগ পান, তখন স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উত্তীর্ণ সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীরা ন্যায্য প্রতিযোগিতায় বৈষম্যের শিকার হন। কারণ, তারা দীর্ঘ একাডেমিক মূল্যায়ন পেরিয়ে যেখানে এসেছেন, সেখানে কওমি ধারার শিক্ষার্থী কোনো সমপর্যায়ের পরীক্ষা বা গবেষণার চাপ ছাড়াই একই মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছেন।
৫. বিকল্প হতে পারত অনার্স সমমান
যদি বাস্তবতা অনুযায়ী বিচার করা হয়, তবে দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতক (honours) সমমান দেওয়া অধিক যৌক্তিক হতো। এরপর যারা আগ্রহী, তারা ‘ব্রিজ প্রোগ্রাম’ বা ‘ফাউন্ডেশন কোর্স’ করে মাস্টার্সে প্রবেশ করতে পারতেন—যেমন অনেক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসার ছাত্রদের জন্য এ ধরনের সেতুবন্ধন কর্মসূচি রয়েছে।
সমাধানের প্রস্তাবনা
কওমী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি Academic Bridging Program চালু করা হোক।
মাস্টার্স স্বীকৃতি স্থগিত করে শরহে বেকায়া/মেশকাত/দাওরায়ে হাদীস ধাপে ভিত্তি করে পর্যায়ক্রমিক সমমান নির্ধারণ করা হোক।
গবেষণাকেন্দ্রিক পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিভাগগুলো তথা তাখাসসুসাতকে মাস্টার্সের সমমান করার বিষয়ে চিন্তা করা হোক কওমি ধারার উন্নয়নে।
কওমি শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হয়—সনদের ‘সমমান’ মানে কেবল মর্যাদা নয়, বরং একাডেমিক দায়বদ্ধতা। যখন একটি শিক্ষাব্যবস্থাকে মাস্টার্সের মর্যাদা দেওয়া হয়, তখন সেই মান বজায় রাখারও বাধ্যবাধকতা থাকে। অতএব, কওমি শিক্ষার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সরাসরি মাস্টার্সের সমান বলে ঘোষণা করার এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: ফাযেল, দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
আরএইচ/