|| কাউসার লাবীব ||
যুগ যুগ ধরেই বৈষম্যের শিকার এদেশের আলেম সমাজ। সমাজে তাদের উপস্থিতি, অবদান, ত্যাগ সবকিছুকেই যেন ছোট করে দেখতে পছন্দ করে একটি পক্ষ। তবুও তারা থেমে নেই। দেশ ও দশের যেকোনো সঙ্কটে জীবন বাজি রেখে এগিয়ে আসেন তারা। পাশে দাঁড়ান অসহায় মানুষের।
বিশ্বকে স্থবির করে দেওয়ার মতো মহামারী ছিল ‘করোনা ভাইরাস।’ দুনিয়া যেন হাশরের ময়দান। সন্তান মা-বাবার লাশ ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলো। কোভিড আক্রান্ত স্বামীকে ফেলে চলে গিয়েছিলো স্ত্রী। কলিজার টুকরো সন্তানকেও যখন ছুঁতে ভয় পাচ্ছিল সেই সময় নিজের জীবন মায়া ত্যাগ করে, পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের পাশে দাঁড়ায় আলেম সমাজ।মসজিদে মসজিদে বলা হয়- আসুন আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াই।
করোনা প্রকোপ যখন ক্রমেই বাড়ছে, অনেক লাশ গোসল কাফন ছাড়াই দাফনের কথা ভাবছিলো মানুষজন। ভয়ে কাছেই যেতে সাহস করেনি কেউ। তখন শেষ বিদায়ের গোসল দিয়ে, আদর-গোলাপ মেখে, কাফনে মুড়িয়ে সম্মানের সঙ্গে মৃত দেশের দাফনের কাজটি করেছিলো আলেম সমাজে। আলেমদের মাধ্যমে পরিচালিত সেবা সংস্থা ‘আল-মারকাজুল ইসলামী’ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেভাবে মৃতদেহ দাফন ও সৎকারে এগিয়ে তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
জুলাই বিপ্লব শুরুর পর প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নীরবে-নিভৃতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে ছিল আলেম সমাজ। পুলিশ-বিজিবি-সেনা বাহিনীর কঠোর বাধা উপেক্ষা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শাহবাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম। দেশের কঠিনতর পরিস্থিতিতে ছাত্রদের পাশে ছিল ‘সাধারণ আলেম সমাজ’। তাছাড়া যার যার জায়গা থেকে ওলামায়ে কেরাম অবদান রেখেছিলেন এই বিপ্লবে।
সরকার পতনের পর পুরো দেশে যখন দুষ্কৃতিকারীরা ভিন্নধর্মালম্বীদের উপাসনায় ও মন্দিরে অযাচিতভাবে হামলা চালানোর মতো বিচ্ছিন্নকিছু ঘটনা ঘটানো তখনই সচেতনভাবেই এগিয়ে আসে আলেম সমাজ। হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষার্থী, চরমোনাই পীরের অনুসারীসহ দেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী ও আলেম সমাজ রাত জেগে পাহারা দেয় হিন্দুদের মন্দির; যা ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করে। পাশের দেশের কিছু গণমাধ্যম যখন ‘বাংলাদেশে সনাতনীদের অত্যাচার করার মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছিলো’ তখন আলেমদের মন্দির পাহারার কার্যক্রম সেই ষড়যন্ত্রকে রুখে দেয়। সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।
তাছাড়া জুলাই বিপ্লবের পর যখন পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে রাস্তায় শৃংখলার অভাবের আশঙ্কায় ছিলো দেশবাসী তখন সাধারণ ছাত্রদের পাশাপাশি রাস্তায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করে মাদরাসার শিক্ষার্থী ও আলেম সমাজ।
অপ্রত্যাশিতভাবে টানা ভারীবর্ষণ এবং ভারত থেকে আসা পানিতে দেশের ১৩টি জেলায় এখন স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর-ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন ৩৬ লাখ মানুষ। এখন পর্যন্ত ৪ জেলায় ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে ৯ নদীর পানি।
দেশের এই পরিস্থিতিতেও বসে নেই মাদরাসা শিক্ষার্থী ও আলেম সমাজ। বন্যার্তদের সহায়তায় জীবন বাজি রেখে কাজ করছে তারা। বন্যাদুর্গত জেলা ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙ্গামাটি ও সিলেটসহ নানা জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন করে কাজ করছে তারা।
‘আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন’র চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ দিনরাত এক করে বানবাসীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ৫০০ টনের বেশি ত্রাণ বিতরণ করছেন তিনি।
তাছাড়া আল-মারকাযুল ইসলামী, হাফিজ্জি চ্যারিটেবল সোসাইটি অব বাংলাদেশ, হাফেজ্জী হুজুর রহ. সেবা ফাউন্ডেশন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম, তাকওয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ফী সাবীলিল্লাহ ফাউন্ডেশন, পিপলস ইমপ্রুভমেন্ট সোসাইটি অফ বাংলাদেশ (পিসব), বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস, ইসলামী ছাত্র মজলিস, মারকাযুল ফুরকান শিক্ষা পরিবার, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ, খেদমতে খালক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সাধারণ আলেম সমাজ, আদদাওয়া ফাউন্ডেশন, মুফতি ওয়াক্কাস রহ. ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন,লক্ষ্মীপুর আলোর দিশারী ফাউন্ডেশন, আল-কাসেম ফাউন্ডেশন, আল-মাদানী ফান্ডেশন, সাদাকাহ ফাউন্ডেশন, আদ-দাওয়াহ কওমী ছাত্র কাফেলা, দারুল আরকাম ইনস্টিটিউট, মাদরাসাতুস সুন্নাহ নোয়াখালী, আল-বিলদান ফাউন্ডেশন, তানযিমুল উলামা ওয়াল আইম্মা, রহমাতুল্লিল আলামিন ফাউন্ডেশন, রাবেতায়ে আবনায়ে রাহমানিয়া, মাহাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, কওমি উদ্যোক্তাসহ নামে-বেনামে আলেমদের নানা সংগঠন কাজ করছে।
পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও বন্যার্তদের জন্য কাজ করছেন অনেক আলেম। গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি রুহুল আমিন, ইসলামি আলোচক মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ্ আইয়ুবী, মুফতি হারুন ইজহার, নাশিদ শিল্পী মুহাম্মদ বদরুজ্জামানসহ অনেকেই রয়েছেন এই তালিকায়।
আলেমগণ তাদের এই তৎপরতা, মানবসেবা থামাবার নন।তারা আরো ব্যাপকভাবে কাজ করতে চান দেশের জন্য, দশের জন্য, মানুষের জন্য।
কেএল/