|| হাসান আল মাহমুদ ||
প্রশংসায় ভাসছে সারাদেশের নানা দেয়ালে আঁকা মাদরাসা শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে দেশজুড়ে বিভিন্ন দেয়ালের নানা আঁকিবুকি মুছে শিক্ষণীয় অঙ্কন, ক্যালিগ্রাফিতে রঙ্গীন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও সজ্জিতকরণে বরাবরের মতো অংশ নেয় মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও।
মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতিতে মুগ্ধ আপমার জনসাধারণ। তাদের অঙ্কিত ক্যালিগ্রাফির পিকচার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ নেট দুনিয়ায় প্রশংসার জোয়ার বইছে।
ডিবিসি নিউজের সাংবাদিক আদিত্য আরাফাত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আঁকা কয়েকটি ক্যালিগ্রাফি পোস্ট করে লিখেন, ‘ওরা অন্ধকারের নয়। ধর্মীয় শিক্ষায় আলোকিত। ওদের রং তুলিতেও সাজছে নগরীর দেয়াল। ওরাও গাইতে পারে। আঁকতে পারে। লিখতে পারে। ভাবতে পারে। চিন্তার উন্নতি ওদেরও কম নয়। ওরা যা বিশ্বাস করে তাই তুলে ধরছে নগরের দেয়ালে। পাঞ্জাবি টুপি দেখলেই ওদের প্রতি ঘৃনার চর্চা করা ঠিক নয়। শিল্পকলা এখনকার মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলেগুলোও কম বুঝে না। ওরাও জাতীয় পতাকা বুকে ধরে। সবার চিন্তা এক না।
আহ্বান জানিয়ে এই সাংবাদিক আরও লিখেন, 'হুজুর-মোল্লা-মৌলভী' বলে ট্রল না করে ভাই বন্ধু হিসেবে ওদের কাছে রাখুন। পাশে রাখুন। কাউকে মূলস্রোতে বিচ্ছিন্ন রেখে দেশ আগায় না। সবাই মিলে বাংলাদেশ। অল্প ক'জনের খারাপ ঘটনার দায়ভার দাঁড়ি-টুপি, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা সবার ওপর দিলে প্যান্ট-শার্ট পরা অনেকের গায়েও জামা থাকবে না!’
চ্যানেল ৯ এর সাবেক সাংবাদিক ডিবিসি নিউজের আরেক সাংবাদিক আবু দাউদ খান লিখেন, মাদরাসা ছাত্রদের ক্যালিগ্রাফির অনেকগুলো ছবি পোস্ট করে লিখেন, ‘হস্তাক্ষরে যে এতো সুন্দর ও শৈল্পিক ক্যালিগ্রাফি হতে পারে তা এরা দেখালো। বাহ চমৎকার। ওরাও মেধাবী।’
আরবিভাষা শিক্ষক মুফতি গোলাম রাজ্জাক কাসেমী’র মতে, ‘আরবি ক্যালিগ্রাফি দিয়েও সময় ও চেতনাকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা যায়। এই জায়গাটায় আরেকটু মনোযোগ দেওয়ার জন্য আরবি ক্যালিগ্রাফারদের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
প্রকাশক লেখক যাকারিয়া মাহমুদ বি বাড়িয়ার আর্টিস্ট উসাইদ মুহাম্মাদ’র করা একটি গ্রাফিতি পিকচার পোস্ট করে লিখেন, ‘সময়, প্রকৃতি ও শিল্পের কম্বিনেশনে অনন্য কারুকাজ। স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে ২য় স্বাধীনতার সেরা শিল্পী হিসেবে রাষ্টীয় পুরস্কার দেওয়া হোক।
আশিক নামে এক ফেসবুকার মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আঁকা অনেকগুলো গ্রাফিতির পিকচার পোস্ট করে লিখেন, ‘এমন ক্যালিগ্রাফিতে চোখের শীতলতা খুঁজে পাওয়া যায়। মনে প্রশান্তি পাওয়া যায়। মাশাল্লাহ। কিন্তু এইসব ক্যালিগ্রাফি দেখে যাদের মনে শান্তি পায় না, চোখ শীতল হয় না, মনে করতে হবে তাদের রুচিতে কুত্তা মুইত্তা দিছে। তাইতো এইসব ক্যালিগ্রাফি দেখে তাদের চুলকানি বাড়ে।
শিক্ষক রাসেল আহমাদ মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতির পিকচার পোস্ট করে লিখেন, ‘টাইমলাইনে থাকুক, প্রতি বছর মেমোরি তে আসবে।’
পোস্টে তিনি লিখেন, ‘এই সুন্দর গ্রাফিতিগুলো রোদে পুড়বে, বৃষ্টিতে ভিজবে একসময় এর সৌন্দর্য আর এত সুন্দর থাকবে না। কিন্তু এই ছবিগুলো সব সময় আমাদের মন কাড়বে। মাদরাসার ছেলেমেয়েদের কেউ অবহেলা করো না, কারণ প্রথম সারির মেধাবী, গুনী ব্যক্তিদের তালিকায় তাদের পদচারণা সব সময় আছে থাকবে।
তার মতে, ‘আরবি আমাদের প্রাণের ভাষা, তেমন বাংলাও আমাদের মাতৃভাষা। তারা (মাদরাসা শিক্ষার্থী) যেমন আরবীতে এত সুন্দর গ্রাফিতি করতে পারে, তেমনি বাংলাতেও পারে। তাদেরকে কেউ দমিয়ে দিও না, তাদের কে উৎসাহ দেও। যেনো শহরে-গ্রামের অলিতে-গলিতে প্রতিটা দেয়ালে যেনো তারা আরবির পাশাপাশি বাংলা এবং ইংলিশেও গ্রাফিতি করে। আবারো বলছি- তাদের কে কেউ দমিয়ে দিও না, তাদের কে উৎসাহ করো। শিল্পীর তুলিকে কখনোই অবহেলা করোনা। কারণ এই তুলি মুক্ত ছড়ায়।’
এদিকে জাতীয় দৈনিক সময়ের আলো’র সহ-সম্পাদক আরিফ খান সাদ জানান, ‘আমাদের দেশের মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম একটি অভূতপূর্ব বিপ্লবকাল পার করছে। এমন বিপ্লব পৃথিবীতে হঠাৎ হঠাৎ আসে। দেশের মানুষ দীর্ঘ দেড় যুগের এক দানবীয় অপশক্তিকে পরাস্ত করতে পেরে উচ্ছ্বসিত। বিচিত্র উপায়ে মানুষ প্রকাশ করছে হৃদয়ে জমে থাকা উচ্ছ্বাস। এর মধ্যে দ্রুততম সময়ে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিজয়ের আনন্দ এবং রক্ত ভেজা বেদনার চিত্র। এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা।
তিনি বলেন, ‘শহরের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে আরবি-বাংলা এবং বিভিন্ন দৃশ্য সম্বলিত নান্দনিক গ্রাফিতি। অনেক গ্রাফিতির সামনে দাঁড়িয়ে দর্শকরা মুগ্ধ এবং বিস্মিত। অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করছেন, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এত সুন্দর গ্রাফিতি করে কীভাবে? এদের হাতের লেখা এত সুন্দর কীভাবে? আসলে এই কৌতূহল একইসঙ্গে আনন্দের এবং বেদনার। কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ইতিহাস মাত্র এক-দুই শতাব্দির নয়; দীর্ঘ দেড় হাজার বছরের ইতিহাস। দীর্ঘ দেড় হাজার বছর ধরে কুরআন-হাদিস এবং এই দুই উৎস থেকে নির্গত অসংখ্য শাস্ত্রের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ভাষ্যগ্রন্থ রচনা এবং রচনার প্রয়োজনে দেড় হাজার বছরের হস্তাক্ষর শাস্ত্র অনুশীলনের ধারাবাহিক প্রয়াসের একটি ক্ষুদ্র প্রকাশই হচ্ছে আজকের দেয়ালে দেয়ালে শোভিত গ্রাফিতি।
এই সাংবাদিকের দাবি, ‘বুকে হাত দিয়ে বলা যায়, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা দেশের অন্যান্য ধারার শিক্ষার্থীদের হাতের লেখার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর এবং সমৃদ্ধ। কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন রুটিন করে চার থেকে পাঁচটি ভাষার হাতের লেখা অনুশীলন করে। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকে ক্যালিগ্রাফি শিল্পে পারদর্শী হয়ে ওঠে। বড় বড় অনেক মাদরাসায় আলাদা বেতনভুক্ত হস্তলিপিবিশারদ শিক্ষক থাকেন, যাদের বলা হয় 'কাতিব সাহেব হুজুর'। কওমি মাদরাসার অনেক শিক্ষার্থী ক্যালিগ্রাফি করে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। আগস্ট বিপ্লব উপলক্ষে দেশের মানুষ এরই একটি ঝলক দেখার সুযোগ পেয়েছে।’
হাআমা/