শাইখ উমায়ের কোব্বাদী: যার কারণে পূর্বসূরি বরণীয় উলামায়ে হক্কানীর মধ্যে এমন ব্যক্তিত্বের সংখ্যাও কম নয় যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পর ইলমের নূর ধারনে উদ্যোগী হয়েছেন। যেমন,
১. আলী ইবনে হামযা। ইমাম কিসাঈ নামেই যিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। ইলমে নাহুর প্রতিটি ছাত্র এই নামের মহান মানুষটির সাথে পরিচিত। আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রে যার রয়েছে বিশাল অবদান। ইমাম শাফিঈ যার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন,
من أراد أن يتبحر في النحو فهو عيال على الكسائي
ইলমে নাহুর ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চাইলে কিসাঈ-র পোষ্যবর্গ হতে হবে। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ০৭/৫৪)
ইলমে কিরাআতেরও অন্যতম ইমাম তিনি। যে সাত কেরাতের কথা আমরা সবাই জানি, সে সাত কেরাতের এক কেরাত তাঁর দিকেই সম্পৃক্ত। তিনি বয়স অনেক হওয়ার পরই ইলমে নাহু শেখা শুরু করেছেন। আল্লামা কিফতী রহ. বলেন,
انما تعلم الكسائي النحو بعد الكبر فلم يمنعه ذلك من ان برع فيه
কিসাঈ বয়স অনেক হওয়ার পরই নাহু শেখা শুরু করেন। এ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনে অধিক বয়স তার জন্য বাধা হয় নি। (আমবাউর রুয়াত ২ / ২৭১)
২. আল্লামা ইবনে হাযম রহ.। ইসলামের ইতিহাসে যারা অমর হয়ে আছেন তিনি তাদের অন্যতম। আল্লামা যাহাবী রহ. তার ব্যাপারে বলেন,
ومن أشهر من ذكر عنهم الطلب بعد كبر السن ابن حزم الأندلسي
বয়স হওয়ার পর যারা ইলম শেখা শুরু করেছেন তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলেন ইবনে হাযম আন্দালুসী।
তার ইলমে ফিকহ অন্বেষণের সূচনা হয়েছিল বিশেষ একটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে। ইবনে হাযম রহ. নিজেই সে ঘটনা বলেছেন। একদিন তিনি এক জানাযায় শরিক হন। তখন এক মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়েন। এক ব্যক্তি তখন তাকে বলল, ওঠ, আগে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামায পড়। তখন তার বয়স ছিল ছাব্বিশ। তিনি তখন নামাযে দাঁড়িয়ে যান। জানাযা শেষে ফিরে আসার সময়ও মসজিদে যান। এবার প্রবেশ করা মাত্রই নামায শুরু করে দেন। তখন তাকে বলা হল, আরে বস বস; এখন নফল নামায পড়ার সময় নয়। তখন ছিল আসরের পর। এ ঘটনাটি তার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। এরপর থেকেই তিনি ইলম অর্জন শুরু করেন। তার এ অজ্ঞতাই ইলম অর্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। (মু‘জামুল উদাবা, ইবনে হাযম রহ.-এর জীবনী)
৩. আবু বকর আল-কফ্ফাল রহ.। শাফেঈ মাযহাবের অন্যতম ইমাম তিনি। আল্লামা সুবুকী রহ. বলেন,
فلما كان ابن ثلاثين سنة أحس من نفسه ذكاء : فأقبل على الفقه
শায়েখ ইমাম আবু বকর আল-কফ্ফাল রহ. বয়সের কোঠা ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়ার পর ইলম অন্বষণের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এক পর্যায়ে ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। (তাবাকাতুশ-শাফিইয়্যা ৫/৫৪)
৪. আবু আবদুল্লাহ আসবাগ ইবনুল ফারজ রহ.। মালেকী মাযহাবের বরেণ্য ফকিহ। আল্লামা যাহাবী রহ. তার ব্যাপারে বলেন,
وطلب العلم وهو شاب كبير
তিনি পৌঢ় বয়সে ইলম অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৬৫৬)
৫. ঈসা ইবনু মুসা গুঞ্জার রহ.। উপনাম ছিল আবু আহমাদ আলবুখারী। মা-ওয়ারাউননাহর তথা ট্রান্স অক্সিয়ানা অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। হাকিম রহ. বলেন,
هو إمام عصره ، طلب العلم على كبر السنِّ ، وطوَّف
তিনি ছিলেন নিজ যুগের ইমাম। পরিণত বয়সে ইলম শিখেছেন। ইলম অন্বেষণে অনেক পরিভ্রমণ করেছেন। (শাযারাতুয যাহাব ১/৩৩০)
৬. হারিস ইবনু মিসকিন রহ.। মিসরের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ২৫০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেছিলেন। আল্লামা যাহাবী রহ. তার ব্যাপারে বলেন,
وإنما طلب العلم على كبَر
তিনি পৌঢ় বয়সে ইলম শিখেছেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১২/৫৪)
৭. ইজ্জুদ্দীন ইবনুস সালাম রহ.। ইলমী আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সত্য কথন ও সাহসী উচ্চারণে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব। আল্লামা ইবনে দাকীকুল ঈদ যাকে সুলতানুল উলামা (উলামা-সম্রাট) উপাধি দিয়েছেন। বাস্তবিক অর্থেই তিনি ছিলেন সম্রাটতুল্য একজন মানুষ। মানুষের হৃদয়জগতে তিনি ছিলেন সম্রাটের চেয়েও সম্মানিত। পরাক্রমশালী শাসকেরা পর্যন্ত মাথা নত করত তার সামনে। ইজ্জুদ্দীন রহ.-এর জানাযার খাট নিয়ে মানুষ যখন শাহী প্রাসাদের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল তৎকালীন শাসক আলমালিকুয যাহির তখন বলেছিল,
আজ আমার রাজত্ব স্থিতিশীলতা লাভ করেছে। এই শায়েখ যদি জনগণকে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বলতেন তাহলে তিনি আমার থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিতে পারতেন। –তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা ৮/২১৫
এই উলামা-সম্রাটও ইলম শেখা শুরু করেছেন বয়স অনেক হওয়ার পরে। তার জীবনীতে লেখা হয়েছে–
كان الشيخ عز الدين في أول أمره فقيرا جدا ولم يشتغل إلا على كبر
ইজ্জুদ্দীন রহ. প্রাথমিক অবস্থায় খুবই গরীব ছিলেন। তিনি ইলম অর্জনে মাশগুল হয়েছেন অনেক বয়সে। (তাবাকাতুশ-শাফিইয়্যাতিল কুবরা ৮/২১৫)
এছাড়াও ফুযাইল ইবনে ইয়ায, ইবনুল আরাবী রহ. প্রমুখের মতো উজ্জ্বল নক্ষত্ররা বয়সের বাধা পেরিয়ে ইলমী অঙ্গনকে শাসন করেছেন।
ইবনু উকাইল রহ. বলেন, আশি বছরের বার্ধক্যে আমি ইলমে যে স্বাদ পেয়েছি তা চল্লিশ বছরে ইলমের স্বাদ অপেক্ষা তীব্র ছিল।
টিএ/