ফাহিম আহমাদ: ইস্তেগফার এমন এক আমল, যা মানুষকে আল্লাহর কাছে ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’ বানিয়ে দেয়। আর ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’ হলো এমন ব্যক্তি, যে ব্যক্তি দোয়া করতে দেরি; কিন্তু সে দোয়া কবুল হতে মুহূর্ত দেরি হয় না।
‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’ হওয়ার আমলটি ছোট্ট এবং সহজ। নিজেকে ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’ হিসেবে তৈরি করতে সব সময় ইসতেগফার করতে থাকা।
ওঠা-বসা চলা-ফেরায় আল্লাহর কাছে ক্ষমা পার্থনার নিয়তে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ (اَسْتَغْفِرُ الله – اَسْتَغْفِرُ الله) বলতে থাকার নিয়মিত আমল করা।
ছোট্ট একটি আমলের কারণেই সামান্য রুটি বিক্রেতা হয়েছিলেন ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’। যার দোয়া আল্লাহ তাআলা অভিনবভাবে কবুল করেছিলেন। যার সাক্ষী ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেই।
ইমাম হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণনায় রুটি বিক্রেতার দোয়া কবুলের ঘটনা-জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিস হজরত ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি সারাজীবন হাদিস সংগ্রহে কাটিয়ে দিয়েছেন।
এটি তার শেষ জীবনের ঘটনা। একবার তিনি বৃদ্ধ বয়সে হাদিস সংগ্রহে এক সফরে বের হয়েছিলেন। সফরের মধ্যে রাত একবার এক মসজিদে মাগরিব আর ইশা নামাজ আদায় করেন এবং রাত অতিবাহিত করার চিন্তা করেন। সময়টি ছিল শীতকাল। তিনি চিন্তা করলেন ফজরের নামাজ পড়েই এ মসজিদ থেকে বিদায় নেবেন।
তিনি মসজিদে বসে শীতের কাপড় মুড়ি দিয়ে হাদিস পড়া শুরু করলেন। এমন সময় মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী এসে বললেন, এ এলাকার নিয়ম হচ্ছে, রাতে মসজিদে থাকা যাবে না।
মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনে হাম্বল অনেক বিনয়ের সঙ্গে বলার পরও মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী ব্যক্তি শুনলেন না। নিরুপায় হয়ে তাকে মসজিদ থেকে বের হতে হলো।
শীতের রাতে হাটতে হাটতে এক বাজারে গিয়ে পৌছলেন। সেখানে রুটি বিক্রেতা এক যুবককে দেখলেন। মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনে হাম্বল রুটি বিক্রেতা যুবককে সালাম দিয়ে বললেন, হে যুবক! শীতের রাত, আমি কি তোমার কাছে আগুনের কাছে বসে রাতটা কাটাতে পারব?
যুবক বিনয়ের সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে বললেন- ‘আহলান, ওয়া সাহলান! আপনাকে স্বাগতম। এটা আমার খোশ নসিব। আপনি এখানে আগুনের পাশে বসে রাত কাটালে আমার কোনো সমস্যা নেই।
মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনে হাম্বল চুলার পাশে বসে হাদিস পড়ছিলেন। কিন্তু তিনি যুবকের একটা আমল লক্ষ্য করলেন। তাহলো-
যুবক রুটি তৈরিতে যা-ই করছেন, তাতেই তিনি ‘আসতাগফিরুল্লাহ’, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলছেন। অর্থাৎ ইসতেগফারের আমল করছেন।
রুটি বিক্রেতা যুবকের এ আমল দেখে মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনে হাম্বলের কৌতুহল বেড়ে গেল। তিনি ভাবনায় পড়ে গেলেন। এবার তিনি হাদিসের কিতাব বন্ধ করে যুবককে বললেন- হে যুবক! তোমার কী হয়েছে? শুরু থেকেই দেখছি, তুমি যে কাজ-ই করছে সঙ্গে সঙ্গে ইসতেগফার (আসতাগফিরুল্লাহ) পড়ে যাচ্ছ।
ঘটনা কী? কেন তুমি এত বেশি ইস্তেগফার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ছো? এবার যুবক তার আমল ও প্রাপ্তির কথা জানালেন এবং আমি ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’। আমি যে দোয়া করি তা কবুল হয়ে যায়।
আমার জীবনের কোনো চাওয়া-ই আল্লাহ বাকি রাখেন নি। তবে আমার একটি দোয়া এখনো কবুল হয়নি। রুটি বিক্রেতা যুবকের কথা শুনে মুহাদ্দিস ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কৌতুহল আরও বেড়ে গেল।
যুবকের এ কথা শুনে মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনে হাম্বল একেবারেই অবাক। তিনি যুবককে আবারও প্রশ্ন করলেন, তুমি ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’? তুমি যে দোয়া কর, তাই কবুল হয়ে যায়?
যুবক বললেন, ‘হ্যাঁ’, আমি দোয়া করলেই কবুল। তবে আমার একটা দোয়া এখনো কবুল হয়নি। সেটি ছাড়া আল্লাহ আমার সব দোয়া কবুল করে নিয়েছেন।
এবার ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল আগ্রহ-কৌতুহল নিয়ে জানতে চান, তোমার সেই দোয়া কী? যা এখনো কবুল হয়নি? এবার রুটি বিক্রেতা যুবক বললেন, আমার যে দোয়া কবুল হয়নি, তাহলো- আমি শুনেছি এ জামানার সবচেয়ে বড় শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল।
আমার ইচ্ছে হলো- ‘তাঁকে এক নজর দেখা এবং তার হাতে হাত রেখে মোসাফাহ কর। আর তাঁর কপালে একটা চুম্বন করা।’ আমি অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি, আল্লাহ তাআলা আমার এ দোয়া এখনও পূরণ করেননি।
আল্লাহ যে কেন আমার এ দোয়াটা কবুল করছেন না; তা আমি বুঝতে পারছি না। এবার মুহাদ্দিস ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি খুবই আবেগ প্রবণ হয়ে গেলেন। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন- হে যুবক! আল্লাহ তোমার এ দোয়াও কবুল করেছেন।
‘হে যুবক! তুমি যে আহমাদ ইবনে হাম্বলের সঙ্গে দেখা করার জন্য দোয়া করছ। তোমার তার কাছে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার প্রভু তাকে তোমার কাছে পৌছে দিয়েছেন।
হে যুবক! আমি-ই ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল। আহমাদ ইবনে হাম্বল নিজেই তোমার কাছে ছুটে এসেছে।’ (সুবহানাল্লাহ) সঙ্গে সঙ্গে যুবক চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে জড়িয়ে ধরলেন।
তার হাতে হাত রাখলেন আর তাঁর কপালে চুমু খেলেন এবং কাঁদকে থাকলেন। মুহাদ্দিস ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালের কাছে দোয়া চেয়ে বললেন- ‘হে ইমাম! আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার কোনো দোয়া-ই বাকি রাখেননি। যা একটা বাকি ছিল তাও আল্লাহ তাআলা কবুল করে নিয়েছেন।
এ হচ্ছে ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’র নমুনা। মহান আল্লাহ তার কাছে অবিরাম ক্ষমা প্রার্থীকে ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’তে পরিণত করে দেন। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, যে কোনো প্রয়োজনে বেশি বেশি ইস্তেগফার করা।
ইস্তেগফারের আমল বিফলে যায় না। ইস্তেগফার করে যে দোয়া-ই করা হয়, তা-ই কবুল হয়ে যায়। আর যদি কোনো বান্দা ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ অর্থাৎ ইস্তেগফারের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে তবে সে হবে ‘মুঝতাঝাবুদ দাওয়াহ’।
আল্লাহ তাআলা ইস্তেগফারের কারণে ওই বান্দার সব চাওয়া পূরণ করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সব সময় বেশি বেশি ইস্তেগফারের সঙ্গে লেগে থাকার তাওফিক দান করুন।
ইস্তেগফারের ছোট্ট আমল বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। সুন্নতে নববির অনুসরণ ও অনুকরণের ৷ তাওফিক দান করুন। আমিন। [মানাক্বেবে ইমাম আহমদ]
লেখক: শীক্ষার্থী, জামিয়া ইউনুছিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া। শিক্ষক মারকাযুল ফুরকান আইডিয়াল মাদ্রাসা ঢাকা।
-এটি