আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ভূমির মালিকানা হলো প্রধান। কিন্তু পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৫ বছরেও সেই মালিকানা নিশ্চিত হয়নি পাহাড়ে। আর এতে বহুল আলোচিত এবং ঐতিহাসিক সেই চুক্তির শতভাগ সফলতা নিয়ে এখনো সংশয় রয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই সমস্যা সমাধানে ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দাবির কারণে তা থমকে রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় ভূমি জরিপ শুরু করা যায়নি এখনো। আর ভূমি জরিপ না হলে ভূমির মালিকানাও নিশ্চিত করা যাবে না।
তবে শান্তিচুক্তির কারণে পাহাড়ে বহুগুণে উন্নয়ন বেড়েছে উল্লেখ করে রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘সমতলের মতো পাহাড়েও উন্নয়ন যজ্ঞ চলছে। ২৫ বছরেও শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমাদের কষ্ট রয়েছে। এজন্য দোষ সাধারণ মানুষের নয়; এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
স্বাভাবিক নিয়মে চুক্তি বাস্তবায়ন হবে। এজন্য আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন, কিন্তু আলোচনার কথা বললেই তারা কোনো না কোনো শর্ত বেঁধে দেয়।’ রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই যে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে এমন মনে করেন না তিনি। তিনি দাবি করেন, ‘সরকার ধারাবাহিকভাবে চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করে গেলেও চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপরপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যার মিশনে নেমেছে। এতে কীভাবে চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব?’
অপরদিকে সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘পাহাড়ে যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেটা কার জন্য হচ্ছে সেটা আমাদের আগে দেখতে হবে। পাহাড়ের যারা স্থায়ী বাসিন্দা তাদের জন্য যদি এই উন্নয়ন না হয়, তাহলে সেই উন্নয়নের কোনো প্রয়োজন নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়নে সরকারের আগ্রহ কম।’
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সেই চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর পাহাড়ে শান্তি ফেরার পথ উন্মুক্ত হয়। প্রাথমিকভাবে জনসংহতির নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। সরকারও তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
সাময়িকভাবে পাহাড়ে রক্তের খেলা, অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হয়। কিন্তু বছর যেতে না যেতে চুক্তির বিরোধিতা করে জনসংহতির একটি অংশ ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (্ইউপিডিএফ) গঠন করে। এরপর শুরু পাহাড়ে দুই আঞ্চলিক দলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ২০০১ সালে তিন বিদেশি অপহরণের মাধ্যমে শুরু হয় পাহাড়ে অপহরণ ‘বাণিজ্য’। পরে ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতি থেকে বের হয়ে ২০১০ সালে আরেক আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালে এসে ইউপিডিএফ থেকে বের হয়ে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হয়, যেটা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পরিচিত। এরপর বিভিন্ন সময় চার পক্ষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলে আসছে। গত দুই বছরে রাঙ্গামাটি জেলায় প্রাণ গেছে প্রায় ৪০ জনের।
সর্বশেষ গত বুধবার রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ির সাজেকে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হন একজন, এ-সময় আরেকজন আহত হন। জনসংহতি সমিতি এই ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করে নিহত ব্যক্তি মোটরবাইক চালক বলে জানান।
তবে পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও ছোঁয়া লাগে। বিশ্ববাসীর কাছে পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটনও ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। এ-সময়ে পাহাড়ে প্রচুর যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ২৪ বছরে প্রচুর বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাধারণ মানুষের উন্নয়নে সরকারও প্রচুর কাজ করে গেছে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুক্তির প্রধান কয়েকটি শর্ত পূরণ হয়নি এখনো। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, উপজাতীয় অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা, প্রশাসনে বেসামরিকীকরণ করা, আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদকে ক্ষমতায়ন করা।
এত বছর পর এসেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য জেএসএস সরকারকে দোষারোপ করছে। ধারা বাস্তবায়ন নিয়ে চলছে দুপক্ষের তর্কযুদ্ধ। এই ২৫ বছর জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে রাজপথে বেশিরভাগ সময় সক্রিয় ছিল, পক্ষান্তরে ইউপিডিএফ সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ, পার্বত্যাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। অন্যদিকে জেএসএস (সংস্কারপন্থি) পক্ষও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। তবে চুক্তি নিয়ে তেমন কোনো কথা এখনো ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) তরফ থেকে শোনা যায়নি।
অপরদিকে এই চুক্তিতে উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলো তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হোঁচট খেয়েছে বলে তাদের দাবি। এ বিষয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন জানান, শান্তিচুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন না করে বরঞ্চ শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চুক্তিকে অব্যাহতভাবে পদদলিত ও খর্ব করছে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য তথা জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম ইস্যু হচ্ছে ভূমি বেদখল ও অবৈধ অনুপ্রবেশের সমস্যা। পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে আশা করা হয়েছিল যে সেখানে বসত গড়া বাঙালিসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বেদখলকৃত জায়গা-জমি জুম্মদের কাছে ফিরিয়ে দিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হবে।
এদিকে গত ২৫ বছরে রাঙ্গামাটিতে প্রচুর উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়েছে। জেলার আরও তিনটি বেসরকারি কলেজকে সরকারিকরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জেলায় শতাধিক কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চুক্তির আগে জেলায় ১২ হাজার পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় থাকলেও বর্তমানে অর্ধ লক্ষাধিক পরিবার বিদ্যুতের সুবিধা গ্রহণ করছে। দুর্গম বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়িতে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় মাইলের পর মাইল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।
-এটি