আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: পরকীয়া হলো ব্যক্তির চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয়। কিন্তু বর্তমানে তা এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এক মহামারী আকার ধারণ করেছে।
প্রযুক্তির কল্যাণে শহর- নগর, গ্রাম-গঞ্জ সব জায়গায় একই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরকীয়ার বিষাক্ত ছোবলে একটি সুন্দর সংসার তছনছ হয়ে যাচ্ছে নিমিষেই, ফলে কোন সন্তান হারায় তার প্রিয় মা/বাবাকে, কোন স্বামী হারায় তার স্ত্রীকে এবং মা-বাবার ভঙ্গ হয় সোনালী স্বপ্ন।পরকীয়া থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, গুণীজন এবং গোটা রাষ্ট্র। কিন্তু সবাই দিশেহারা।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এখনই এর লাগাম টেনে ধরা না হলে মুসলিম সমাজ ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাবে। হারাবে তার গৌরবময় ইতিহাস- ঐতিহ্য, সভ্যতা- সংস্কৃতি। গড়ে ওঠবে পশ্চিমাদের আদলে এক নতুন অভিশপ্ত সমাজ ব্যবস্থা।
পরকীয়া কি?
পরকীয়া হচ্ছে, বিবাহিত জীবন থাকা স্বত্ত্বেও অন্য কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত প্রেম করা (অর্থাৎ সাক্ষাতে অথবা মোবাইল- ফোনে অডিও- ভিডিওতে কথা বলা, চ্যাটিং ও মেসেজ আদান-প্রদান করা) অথবা যৌন সম্পর্ক করা (অর্থাৎ একে অপরকে টাচ ,আলিঙ্গন , চুম্বন কিংবা দৈহিক মিলন করা।)
পরকীয়ার কারণ:
বিভিন্ন কারণেই পরকীয়া সম্পর্ক হয় তবে মৌলিকভাবে নিম্নোক্ত কারণগুলোকে চিহ্নিত করা যায়।
১.স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খোদাভীরুতা, আখেরাতমুখীতা, দুনিয়াবিমুখতা ও কৃতকর্মের জবাবদিহিতার ভয় না থাকা।২. নৈতিক অবক্ষয় ও আত্মিক কলুষতা ৩. কষ্ট সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা,অল্পে তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতার মত মহৎ গুণাবলীর অনুপস্থিতি। ৪.পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধিকারী টিপস গ্রহণ না করা। ৫.অতৃপ্তি, অপ্রাপ্তি বা অপূর্ণতা।
অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মধ্যে যে গুণ বা বৈশিষ্ট্য আশা করে (মানসিক, আর্থিক, দৈহিক, যৌন বা অন্য যেকোন), সংগত কারণেই তার সবগুলো তারা পায় না। সেই 'না পাওয়া' তাদের কে প্ররোচিত করে অন্য কারো মধ্যে সেগুলো খুঁজতে। এই খোঁজা থেকেই পরকীয়ার শুরু। ৬, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক বা মানসিক দূরত্ব। দুজনের মনের বা মতের মিল, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা ইত্যাদি না থাকা মানেই মনের দূরত্ব। আর একজনের প্রতি আরেকজনের শারীরিক আকর্ষণ না থাকার কারণে তৈরী হয় শারীরিক দূরত্ব।
৭.নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও পর্দাহীনতা। ৮.পরকীয়া সংশ্লিষ্ট আইন বাস্তবায়ন না করা
ইসলামের দৃষ্টিতে পরকীয়ার প্রতিকার: ইসলাম একটি সার্বজনীন,যুগোপযোগী ও কল্যাণমূখী ধর্ম।তাই পরকিয়ার প্রতিকারে ইসলাম যেসব নীতিমালা এবং দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে তা অন্য যেকোন মতবাদ ও তন্ত্র-মন্ত্র থেকে অধিক শক্তিশালী,বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবধর্মী। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা পরকীয়াকে দুই ভাগে বিভক্ত করব।
এক, স্বামী-স্ত্রী পরকীয়ায় জড়ানোর পূর্ব অবস্থা ।
দুই. পরকীয়ায় জড়ানোর পরের অবস্থা ।
আজকের লেখায় শুধু প্রথম বিষয়টি তুলে ধরব। ইসলাম পরকীয়ার প্রতিকারে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করেছে।
এক. সর্বপ্রথম স্বামী-স্ত্রীকে খোদাভীরুতা, আখেরাতমুখীতা, দুনিয়াবিমুখতা ও কৃতকর্মের জবাবদিহিতার ভয় অর্জনের প্রতি জোর তাকিদ করেছে। কারণ যারা উক্ত গুনে গুণান্বিত হবে তারা দাম্পত্য জীবনে কখনো আল্লাহ বিধান লঙ্ঘন করবে না।পরনারী ও পরপুরুষ আসক্ত হবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জীবন সঙ্গী কে সৃষ্টি করেছেন।আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।-( সূরা নিসা,১)
তোমরা ঐ দিনকে ভয় কর, যেদিন আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না। (সূরা বাকারা-২৮১)
দুই. ইসলাম স্বামী-স্ত্রীকে নৈতিক শিক্ষা অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। আত্মিক কলুষতা মুক্ত হতে এবং কষ্ট সহিষ্ণুতা, ধৈর্যশীলতা,অল্পে তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতার মত মহৎ গুণাবলী অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে। কারণ মানুষের চাহিদা অসীম। সসীম জগতে তা মেটানো সম্ভব নয়। তাই দাম্পত্য জীবনে তারা যদি ধৈর্যশীল ও সহানুভূতিশীল হয়, সুখ-দুখ খুশিমনে মেনে নেয়, আল্লাহর দেয়া আর্থিক, শারীরিক এবং মানসিক শক্তি -সামর্থ্যের উপর তুষ্ট থাকে,তাহলে তারা কখনো পরকীয়ায় জড়াবে না।দাম্পত্য জীবনকে আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে মনে করবে।
তিন. পারস্পরিক ভালোবাসা ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় এমন কিছু টিপস গ্রহণ করতে স্বামী- স্ত্রীকে আদেশ দিয়েছে।
যেমন মাঝেমধ্যে একই পাত্র থেকে আহার গ্রহণ , একে অপরের মুখে লোকমা উঠিয়ে দেওয়া।
চিন্তিত দেখলে একে অপরক সান্ত্বনা দেওয়া ও সাহস যোগানো। আম্মাজান খাদিজা রা. রাসুল( স)এর দুঃখের সময় তার পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন।
নিজ কর্মস্থল থেকে ফিরে হাস্যোজ্জ্বল ও সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করা। স্ত্রী হৃদয়কাড়া চাহনি ও মুচকি হাসি দিয়ে বরণ করা। অফিসে যাওয়ার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া ,জুতা ইত্যাদি ঠিকঠাক করে দেয়া। কপালে কিংবা হাতে চুমু খাওয়া।
বাসা-বাড়ী এবং নিজেকে সর্বদা পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখা। পরিতাপের বিষয় হলো, স্ত্রীরা বাসায় সাধারণ পোশাকে নোংরা ভাবে থাকে। কিন্তু বাহিরে বের হলে পরীর মত সাজগোজ করে।উন্নত পারফিউম ব্যবহার করে। অথচ প্রিয় মানুষটির সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশই ছিল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় এবং স্বামীর হৃদয়রাজ্য রানী হওয়ার মূলমন্ত্র।
সাংসারিক কাজকর্মে স্ত্রীকে সাহায্য করা।হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও পরস্পরকে সময় দেওয়া। খোশগল্প করা ও ভালোবাসা প্রকাশ করা। সংসারের সুখ দুঃখ শেয়ার করা।মোটকথা পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা।নিজেদের মধ্যে শারীরিক কিংবা মানসিক কোন ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হতে না দেওয়া। যাতে পরকীয়ার কল্পনাও না আসে।
চার. বর্তমানে আমরা কেউ ভেবে দেখিনা বা দেখতে চাইনা এ পরকীয়ার উৎস কোথায়? এর মূল উৎস পর্দাহীনতা ও নগ্নতা। তাই কল্যাণের ধর্ম ইসলাম সেই উৎসটাই উপড়ে ফেলতে চেয়েছে। পুরুষকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে দৃষ্টি অবনত রাখতে আর
আর নারীকে বলেছে দৃষ্টি অবনত রাখার পাশাপাশি দৈহিক সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখতে। শরীয়ত উভয়কে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে ,কোমল ভাষায় কথা বলতে ও পর্দা ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করেছে।
হে নবী!মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। ইহাই তাদের জন্য উত্তম। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন,তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। সূরা নূর,৩০-৩১
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সা)বলেন আল্লাহ তাআলা বলেছেন: দৃষ্টিপাত শয়তানের একটি বিষাক্ত তীর। যে ব্যক্তি মনের চাহিদা সত্ত্বেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আমি তাকে সুদৃঢ় ঈমান দান করব, যার মিষ্টতা সে অন্তরে অনুভব করবে। (আল মু'জামুল কাবীর তাবারানী,হাদীস:১০৩৬২)
হে নারীরা!তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করো, জাহেলী যুগের মতো সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না। (সূরা আহযাব,৩৩)
শালীন পোশাকে নিজেকে আবৃত করে বের হওয়া
ভদ্র ও শালীন পোশাক পরে প্রয়োজনে বাহিরে যাওয়া। অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের সৌন্দর্য বিকশিত হয় এমন আঁটসাঁট বা পাতলা পোশাক পরিধান না করা। এতে পরকীয়া ও বখাটে ছেলেদের ইভটিজিং থেকে নিরাপদ থাকবে।
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, আপনার কন্যাদের ও মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বলুন,তারা যেন তাদের চাদর নিজেদের মুখের উপর নামিয়ে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে,ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। (সূরা আহযাব ৫৯)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.)বলেন,এমন নারীরা জাহান্নামী,যারা বস্ত্র পরিধান করেও (পাতলা কিংবা আঁটসাঁট হওয়ার কারণে) বিবস্ত্র থাকে। পর পুরুষকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথার চুলের খোঁপা হবে উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়।তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণ ও পাবে না। অথচ তা বহু দূর থেকে পাওয়া যায়।( মুসলিম শরীফ,হাদিস: ৫৭০৪)
পর পুরুষের সাথে অবাধে মেলামেশা ও একাকীত্বে খোশগল্প না করা প্রয়োজন ছাড়া পর পুরুষের সাথে কথা না বলা। বলতে হলে স্বাভাবিক ভাবে বলা। আকর্ষণীয় ও কোমল কন্ঠে নয়।কোন অবস্থায়ই একাকীত্বে খোশগল্প না করা।
যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো,তবে পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে কুবাসনা করে। তোমরা সঙ্গত কথা বলো।(সূরা আহযাব, ৩২)
উমর রা.থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,কোন বেগানা নারী-পুরুষ একাকী অবস্থান করলে শয়তান তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে সেখানে উপস্থিত হয় (তাদেরকে কুকর্মের কুমন্ত্রণা দেয়) (সুনানে তিরমিযী, হাদিস:১৪১৯)
পাঁচ. মানুষ বৈচিত্র্যময়। উপদেশ সকলের জন্য ফলপ্রসূ হয় না।তাই ইসলাম যে নারী বা পুরুষ পরকীয়ার পরিণামে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে, তারা বিবাহিত হলে, প্রস্তরাঘাতে তাদের প্রাণনাশ, অবিবাহিত হলে একশত বেত্রাঘাত করার মতো কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে।
হাদিসে অবৈধ যৌন মিলনের ছয়টি অশুভ পরিণামের কথা বর্ণিত হয়েছে। তিনটি দুনিয়ায়-১, শ্রীহীনতা ২দারিদ্রতা।৩,আয়ুষ্কাল হ্রাস। আর পরকালে তিনটি –১,আল্লাহর ক্রোধ।২,মন্দ হিসাব.৩,দোযখের শাস্তি "শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকী;
পরিশেষে দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, আমাদের সমাজ থেকে পরকীয়া দূর করতে হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ইসলামের দিক নির্দেশনা গুলো ফলো করতে হবে। বিশেষত প্রতিটি নাগরিককে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। তাদের মধ্যে খোদাভীরুতা ,আখেরাতমুখিতা সৃষ্টি করতে হবে। সর্বোপরি পরকীয়া সম্পর্ক কারীদেরকে রাষ্ট্র কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে।
আল্লাহ তাআলা সকলকে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজকে পরকীয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
-এটি