আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে কাগজ। বই-পুস্তক, গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র, খাতা থেকে শুরু করে ব্যাংক চেক ও মুদ্রায় পর্যন্ত কাগজের ব্যবহার ব্যাপক। ফলে কখনো কখনো এক টুকরা কাগজের দাম হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতিদিন প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কাগজের ওপর নির্ভরশীল।
মুদ্রণশিল্পের বিকাশে মুসলমানদের অবদানউন্নত কাগজের ব্যবহার ও কাগজশিল্পের উন্নতি বিশ্বকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। বিশ্বব্যাপী কাগজশিল্পের উন্নয়নে মুসলমানদেরও অবদান রয়েছে।
মুসলমানরা কাগজ তৈরি আয়ত্ত করে চীনাদের কাছ থেকে। ৭৫১ সালে তাল্লাস যুদ্ধে চীনা কিছু কাগজশিল্পী আটক হয়। এরপর থেকে মুসলিমরা বাগদাদে কাগজ বানানো শুরু করে। যুদ্ধবন্দি কাগজশিল্পীদের কাছ থেকে মুসলমানরা চীনা কাগজ নির্মাতাদের গোপন পদ্ধতিগুলো দ্রুত আয়ত্ত করে নেয়। এরপর কাগজশিল্পে তারা নতুন বিপ্লব ঘটাতে শুরু করে।
বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে নতুন নতুন কাগজ তৈরির কারখানা, যা দ্রুত দামেস্ক, তিবেরিয়াস ও সিরিয়ার ত্রিপোলি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ফলে দিন দিন কাগজ উৎপাদন বাড়তে থাকে। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কারণে এর দামও মানুষের নাগালে আসতে থাকে। অল্প সময়েই এই অঞ্চলের কাগজ ইউরোপেও রপ্তানি শুরু হয়ে যায়।
ইউরোপের কাগজের চাহিদা মেটাতে দামেস্কে বড় বড় কাগজ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরিয়ায় হেম্প নামক একটি ঘাস পাওয়া যেত, যার তন্তুগুলো ছিল অত্যন্ত মজবুত। এই তন্তুগুলো দিয়ে খুব উন্নতমানের কাগজ বানানো যেত, যে কারণে সিরিয়ান কাগজের কলগুলোর তৈরীকৃত কাগজের চাহিদা বেশি তৈরি হয়েছিল। বর্তমানেও হেম্প নামক ঘাস থেকে বানানো কাগজ নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং কাঠ থেকে কাগজ বানানোর চেয়ে হেম্প থেকে বানানো কাগজ অর্ধেকের চেয়েও বেশি মূল্যসাশ্রয়ী। হেম্প আবিষ্কার করার পাশাপাশি মুসলিমরা লিনেনও আবিষ্কার করে।
চীনাদের ব্যবহার করা মালবেরি (তুঁত) গাছের বাকলের বিকল্প হিসেবে লিনেন ব্যবহার করা হতো। লিনেনগুলো ভেঙে পানি ভেজানো হতো। এরপর এগুলোকে রোদে শুকানো হতো। এরপর এগুলো সিদ্ধ করে ধুলাবালি সরিয়ে ফেলা হতো। এরপর এই লিনেনের বলগুলোকে পিটিয়ে মণ্ড বানানো হতো। হাতুড়ি দিয়ে মণ্ড বানানোর এ প্রণালীটিও মুসলিমরা আবিষ্কার করেছিল। মুসলিমরা কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যান্য কাঁচামাল নিয়েও গবেষণা চালিয়েছিল। তারা একবার তুলা দিয়ে কাগজ বানানোর জন্য চেষ্টা চালিয়েছিল।
মাদ্রিদের এস্কোরিয়াল গ্রন্থাগারে খুঁজে পাওয়া ১১ শতাব্দীর একটি পাণ্ডুলিপিতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের এমন সব প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৮০০ সাল নাগাদ মিসরেও কাগজ তৈরি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয়, দশম শতাব্দীতে মিসরেই সর্বপ্রথম কাগজে পবিত্র কোরআন লেখা হয়।
এরপর মিসর থেকে পশ্চিমের দিকে উত্তর আফ্রিকা এবং মরক্কোতেও কাগজ তৈরির পদ্ধতি প্রবেশ করে। এরপর কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া মুসলিম স্পেনে এলে ৯৫০ সালের মধ্যে আন্দালুসিয়ানরাও কাগজ তৈরিতে লেগে পড়ে এবং খুব তাড়াতাড়ি তারা শাতিবি নামক চকচকে এক প্রকার বিশেষ কাগজ তৈরির জন্য খ্যাতি লাভ করে।
২০০ বছরের মধ্যেই কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া পদ্ধতি বাগদাদে ছড়িয়ে পড়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাগজ মুসলিম বিশ্বের একটি দৈনন্দিন ব্যবহার্য উপাদানে পরিণত হয়। এর আগে বই প্রস্তুতকরণে কাগজের বদলে বিরল এবং দামি কাঁচামাল ব্যবহার করা হতো, যার কারণে বই লেখা ও প্রকাশ প্রক্রিয়া ছিল বেশ ব্যয়বহুল।
এ ছাড়াও বিভিন্ন উপাদান দ্বারা লেখা সম্পন্ন করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কাগজ সহজলভ্য হওয়ায় এই কষ্ট কমে যায়। কাগজের সহজলভ্যতায় তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে হাজার হাজার বই লেখা শুরু হয়। বই প্রকাশের এই আধিক্য শিক্ষা এবং বইয়ের বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দেয়। শত বছর পর ইউরোপে প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কার হলে বই প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ায় আরেকটি বিপ্লব ঘটে।
কাগজ তৈরির গতি সম্প্রসারণের কারণে কিছু পেশা (যেমন—কালি তৈরি, পাণ্ডুলিপি তৈরি ইত্যাদি) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বইয়ে ক্যালিগ্রাফিকারী এবং বই প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা সবাই উপকৃত হয়। ১১ শতাব্দীতে বিখ্যাত তিউনিসিয়ান লেখক ইবনে বাদিস তাঁর রচিত ‘স্ট্যাফ অব দ্য স্ক্রাইবস’ বইটিতে কলম, লেখার জন্য রঙিন কালি তৈরি, কাগজ তৈরি, রঞ্জক পদার্থ ও মিশ্রণের রং তৈরির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন।
১২৯৩ সালে বোলোগানায় ইউরোপের সর্বপ্রথম কাগজের কল স্থাপিত হয়েছিল। ১৩০৯ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে প্রথম কাগজের ব্যবহার হয়েছে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। সে সময় এত কাগজ তৈরি হওয়ায় কাগজের দাম অত্যন্ত কম ছিল। আর এ কারণেই সে সময় প্রচুর বই লেখা হয়েছে বলে ইতিহাসবিদরা মতামত ব্যক্ত করেছেন।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সে সময় জ্ঞানের আদান-প্রদান বেশি ঘটার নেপথ্যে কারণ ছিল কাগজের সহজলভ্যতা। ড্যানিশ ইতিহাসবিদ জোহানেস পেডেরসন বলেছেন, ‘বৃহৎ আকারে কাগজ উৎপাদন হওয়ার সুযোগে মুসলিমরা যে শুধু ইসলামিক বই লেখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা নয়; বরং তারা বই লেখা এবং বই ছাপানোসহ বই প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ার সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এভাবে মুসলমানদের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী কাগজ সহজলভ্য হয়ে ওঠে, যা মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
-এটি