।। মুফতি রফিকুল ইসলাম আলমাদানী ।।
জুম’আর দিন ফরজ নামাজের আগে যে নামাজ পড়া হয় তাকে জুম’আর আগের নামাজ বা ক্বাবলাল জুম’আ বলা হয়।
জুম’আর আগে নামাজ মহানবী (স.) পড়েছেন। সাহাবা তাবেয়ীগণ পড়েছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে মুসলিম বিশ্বে এই ক্বাবলাল জুম’আ পড়ার বিধান। চির মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে কথিত গবেষকরা বর্তমানে বিতর্ক শুরু করার ধুম্রজালে নিপতিত হয়েছে।
ইসলাম ধর্ম আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। গোটা বিশ্বের প্রতিটি জনপদে মুসলিমরা বর্তমানে লাঞ্চিত বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতি সর্বত্র ধ্বংসের পথে। এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে গবেষক নামের কতিপয় জ্ঞানপাপী চির মীমাংসিত বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যে ফাটল সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন অবান্তর বিতর্ক। হারাম ও নিষিদ্ধ কাজে সতর্ক করা অবশ্যই জরুরি। যে সব বিষয়ে যুগ যুগ ধরে সাহাবা তাবেয়ী ও মুসলিম উম্মাহর আমল চলে আসছে,একাধিক হাদীস বর্ণিত আছে,আছে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী দলীল প্রমাণ। এসব বিষয়ে ফাটল সৃষ্টির পায়তারা করা, বাড়াবাড়ি ও অপপ্রচার করা কোনো মুসলমান আলেমের কাজ হতে পারে না। বরং এসব বিষয়ে উম্মাদনা তার জন্যেই মানায় যে তার মূর্খতারও খবর রাখে না।
জুম’আর নামাজের পূর্বে নামাজ আদায় করার প্রতি প্রমাণ বহন করে এমন একাধিক বিশুদ্ধ সহীহ হাদীস রয়েছে। ওই হাদীসগুলো বিভিন্ন পর্বে ভাগ করা যায়। অংশ বিশেষ নিম্নে আলোচনার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
১. তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামাজ
সাহাবী আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন,
اذا دخل احدكم المسجد فلايجلس حتى يصلى ركعتين
‘তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, সে যেন দু’রাক’আত নামাজ না পড়ে না বসে।’ (সহীহ বোখারী—১/৬৩হা.১১৬৭, সহীহ মুসলিম—১/২৪৮হা.৭১৪)
মসজিদে প্রবেশ করার পর বসার আগে দু’রাক’আত নামাজ পড়া সুন্নত। মতান্তরে ওয়াজিব। এই নামাজকে তাহিয়্যাতুল মসজিদ বা দুখুলুল মসজিদ বলা হয়। অতএব যে ব্যক্তি জুম’আর দিন মসজিদে প্রবেশ করবে, জুম’আর আগে সময় হলে তার জন্য এই নামাজ পড়া সুন্নত যা বোখারী ও মুসলিমের বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয়। যে বলে জুম’আর আগে দুই রাকআত,চার রাকআত কোনো নামাজ নেই,ওই কথার কোনো ভিত্তি নেই। বরং তা সম্পূর্ণ মনগড়া ও জাহিলিয়্যাতের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
২. আযানের পর নামাজ
আযানের পর নামাজ পড়া সম্পর্কিত অনেকগুলো সহীহ হাদীস রয়েছে। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন,
بين كل اذانين صلاة ... لمن شاء
‘প্রত্যেক আযানের পর ইকামতের আগে নামাজ আছে, যে পড়তে চায়।’ (সহীহ বোখারী—১/৮৭হা.৬১৮)
অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,
بين كل اذانين صلاة الا المغرب
‘মাগরিব ব্যতীত সব নামাজের আযান ইকামতের মাঝে নামাজ আছে।’
(আবু দাঊদ—১/১৮২হা.১২৮৪আরবের প্রখ্যাত গবেষক ইমাম হায়সামী লিখেন এর সনদ সহীহ,মাজমা—৫/৫৬০)
এ পরিসরে উল্লেখ্য, যে ব্যক্তি জুম’আর আযানের পর মসজিদে থাকবে, আযানের পর তার জন্য জুম’আর আগে নামাজ পড়া সুন্নত। যা একাধিক সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত। ইতিমধ্যেই কতিপয় হাদীস এ পর্বে উল্লেখ করা হবে।
৩. জুম’আর আগে নামাজ পড়ার প্রতি রাসূল (স.)—এর নির্দেশ
সাহাবী জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, সুলাইক নামক এক সাহাবী (রা.) জুম’আর দিন জুম’আর আগে মসজিদে প্রবেশ করেন। রাসূলূল্লাহ (স.) তখন মিম্বরে বসা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (স.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি নামাজ পড়েছো? তিনি বলেন, না । রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, قم فاركع ركعتين দাঁড়াও! দু’রাক’আত নামাজ আদায় করো। (সহীহ বোখারী, সহীহ মুসলিম)
এই হাদীসে লক্ষ্যণীয় হলো মহানবী (স.) সুলাইক (রা.)—কে জুম’আর আগে দু’রাক’আত নামাজ পড়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এতে জুম’আর পূর্বে নামাজ পড়ার গুরুত্ব এবং প্রমাণ বহন করে। অবশ্য এই নামাজ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ছিল নাকি ক্বাবলাল জুম’আ ছিল তা একটি গবেষণাপূর্ণ বিষয়। তবে এতে জুম’আর পূর্বে নামাজ পড়ার নির্দেশনা ও বৈধতা রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
৪. জু’মআর দিন অতি সকালে মসজিদে যাওয়ার হাদীস
সাহাবী আউস ইবনে আউস আস সাক্বাফী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,
من غسل يوم الجمعة واغتسل وبكر وابتكر وستى ولم يركب ودنا من الامام فاستمع ولم يلغ كان له بكل خطوة عمل سنة اجر صيامها وقيامها
‘যে ব্যক্তি জুম’আর দিন সব অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ ধৌত করবে, গোসল করবে, প্রথম প্রহরে তাড়াতাড়ি বের হবে, কিছুতে আরোহণ না করে যথাসম্ভব হেঁটে যাবে এবং ইমামের কাছে বসে খুৎবা শুনবে, অযথা কিছু করা ও বলা থেকে বিরত থাকবে, তার জন্য প্রতি কদমে এক বছর রোজা রাখা ও নামাজ পড়ার বিনিময় রয়েছে।’ (আবু দাউদ—১/৫০হা.৩৪৫, তিমমিজী—১/১১১হা.৪৯৬, হাদীসটি সহীহ)
এই হাদীসে জুম’আর দিন তাড়াতাড়ি মসজিদে যাওয়ার বিশাল বিনিময় ঘোষণা করা হয়েছে। বোঝার বিষয় হলো, যে ব্যক্তি খুৎবা শুরু হওয়ার আগেই মসজিদে পৌঁছে যাবে সে ওই সময়টাতে মসজিদে কী করবে? নামাজ, তিলাওয়াত, যিকির,তাসবীহ ও যে কোনো ইবাদত করা তার জন্য অনেক কল্যাণের কাজ। এতে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারে না।
অতএব জুম’আর পূর্বে কোনো নামাজ নেই এসব বাজে মন্তব্য একমাত্র কুরআন—সুন্নাহকে অস্বীকারকারী ও মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। এ পরিসরে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে,অসংখ্য সহীহ হাদীসে ইমাম আগমনের পূর্বের সময়টা নামাজ আদায়ের মাধ্যমে পুণ্য লাভের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। নিম্নে এমন কিছু হাদীস উপস্থাপন করা হবে।
৫. জুম’আর পূর্বে নামাজের বিনিময় সম্পর্কিত হাদীস ।
প্রখ্যাত সাহাবী সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,
لايغتسل رجل يوم الجمعة و يتطهر ما استطاع من طهر و يدهن من دهنه او يمس من طيب بيته ثم يخرج فلا يفرق بين اثنين ثم يصلى ما كتب له ثم يصيت اذا تكلم الامام الا غفر له ما بينه و بين الجمعة الاخرى
‘কোনো পুরুষ যখন জুম’আর দিন গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, তৈল অথবা ঘরে থাকা কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করে, অতঃপর জুম’আর জন্যে বের হয় এবং বসার জন্য দু’জনকে পৃথক না করে, অতঃপর সাধ্যমতো নামাজ আদায় করে এবং ইমাম যখন খুৎবা দেয় তখন চুপ থাকে, তাহলে পরবর্তী জুম’আ পর্যন্ত তার যাবতীয় পাপ ক্ষমা করা হয়।’ (সহীহ বোখারী—১/১২১হা.৮৭৩)
এই হাদীসটি সহীহ বোখারীর বর্ণনা। ফলে জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির পক্ষে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ মর্মে আবু দাঊদ, তিরমিজী ইত্যাদি কিতাবে আরো হাদীস বর্ণিত আছে। আছে আবু হুরায়রা, আবু দারদা, আবু সাঈদ খুদরী এবং হুযাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত কয়েকটি হাদীস। সার্বিকভাবে প্রতিটি হাদীসই সহীহ—বিশুদ্ধ। এগুলোতে ইমাম খুৎবা প্রদানের আগে নামাজ পড়ার বিশাল বিনিময়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এসব হাদীসে খুৎবার পূর্বে পড়ার এই নামাজের কোনো নাম উল্লেখ নেই। তবে জুম’আর আগে যে নামাজ পড়া হয় তাকেই ক্বাবলাল জুম’আ বলা হয়। ক্বাবলাল জুম’আ বাক্যের আভিধানিক অর্থই হলো জুম’আর আগের নামাজ।
এ মর্মে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি বিস্তারিত হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো, সাহাবী আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন,
من اغتسل يوم الجمعة و استاك و مس من طيب ان كان عنده ولبس من احسن ثيابه ثم خرج حتى ياتى المسجد فلم يتخط رقاب الناس ثم ركع ماشاء ان يركع ثم انصت اذا خرج الامام فلم يتكلم حتى يفرغ من صلاته كانت كفارة لما بينها وبين الجمعة التى قبلها قال و كان ابو هريرة يقول و ثلاثة ايام زيادة ان الله جعل الحسنة بعشر امثالها
‘যে ব্যক্তি জুম’আর দিন গোসল করে ও মেসওয়াক করে, সুগন্ধি থাকলে ব্যবহার করে, নিজের উত্তম কাপড়টি ব্যবহার করে, অতঃপর বের হয়ে মসজিদে আসে, এবং মানুষের কাঁধ ডিঙ্গানো থেকে বিরত থাকে, এরপর ইচ্ছা মতো রুকু করে, এরপর ইমাম বের হওয়ার পর থেকে নামাজ শেষ করা পর্যন্ত চুপ থাকে তাহলে এই জুম’আ থেকে এর আগের জুম’আ পর্যন্ত তার সব পাপের ক্ষমা হয়ে যায়।’
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এর সাথে আরো তিন দিনের পাপ ক্ষমা হয়ে যায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা সৎকর্ম দশগুণ বৃদ্ধি করে দেন। (আবু দাউদ—১/৫০হা.৩৪৭, আহমদ—১৮/২৯২হা.১১৭৬৬৮, এই হাদীসটি হাসান পর্যায়ের তবে বোখারীর হাদীসের সমর্থবোধক হওয়ার কারণে সহীহ হিসেবে গণ্য হবে। তাই আলবানী এটাকে তার লিখিত সহীহ আবু দাউদ,সহীহ ইবনে খুযাইমা, সহীহ ইবনে মাজাহ এবং সহীহু জামিউস সাগীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।)
৬.রাসূলুল্লাহ (সা.) ক্বাবলাল জুম’আ পড়তেন
সাহাবী আলী (রা.) থেকে বর্ণিত,
كان النبى صلى الله يركع قبل الجمعة اربعا لا يفصل فى شىيئ منهن
‘রাসূলুল্লাহ (স.) জুম’আর আগে চার রাক’আত পড়তেন, এর মধ্যে পৃথক করতেন না।
( আল ফাওয়াইদ,ইমাম আবুল হাসান আল খিলায়ী রহ.৪৯২ হি.। হাফিযুল হাদীসদের মতে এই হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে। ইমাম আবুল হাসান আল খিলায়ী আল ফাওয়াইদ কিতাবে নির্ভরযোগ্য সনদে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তরহুত তাছরীব, আবু যুরআ ইরাকী— ৩/৩৬, দেখুন,ফয়জুল কাদীর মুনাভী— ৯/৪৮৭৫) সনদটি নিম্নরূপ
ابو اسحاق السبيعي عن عاصم بن ضمرة عن على عن النبى صلى الله عليه وسلم
তবে ইবনে মাজাহ কিতাবে উল্লিখিত এই হাদীসটি আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছে।(১/৭৯ হা.১১২৯) এই সনদটি অতিদুর্বল এতে কোনো সন্দেহ নেই। যার ফলে কিছু বিভ্রান্তকারী হাদীসটির এই দুর্বল সনদটি উল্লেখ করে সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্নত করে থাকে। অথছ এই হাদীসের সহীহ সনদও রয়েছে।
মোটকথা, রাসূলুল্লাহ (স.) ক্বাবলাল জুম’আ চার রাক’আত পড়েছেন, এই বর্ণনাটি সহীহ সনদেও বর্ণিত আছে। যারা এই হাদীসের সহীহ সনদটি উল্লেখ না করে শুধু বিতর্কিত সনদটি উল্লেখ করে তারা অবশ্যই খিয়ানত ও বিভ্রান্তিমূলক অপকর্মে লিপ্ত আছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে অনেকগুলো সহীহ হাদীস এবং সাহাবা, তাবেয়ীগণের আমল ও তাদের ইজমা এ পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। এ আলোচনার শেষে এ হাদীস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে।)
৭. সাহাবাগণ ক্বাবলাল জুম’আ পড়তেন
সাহাবা, তাবেয়ী এবং গোটা বিশ্বের মুসলমানগণ পনেরো শত বছর যাবৎ জুম’আর পূর্বের নামাজ পড়ে আসছে। বিশিষ্ট সাহাবাগণ থেকে এ বিষয়টি সহীহ সূত্রে ব্যাপকভাবে হাদীস গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। নিম্নে বিশেষ কয়েকটি বর্ণনা উল্লেখ করা হলো।
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.)—এর আমল
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.)—এর ছেলে তার পিতা সম্পর্কে বলেন,
كان يصلى قبل الجمعة اربعا
‘তিনি ক্বাবলাল জুম’আ পড়তেন চার রাক’আত’
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/১১৪ হা. ৫৪০২ মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ৩/২৪৭ তহাবী ১/৩৩৫ ইমাম যাহাবী বলেন, বর্ণনাটি হাসান। সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/১৪৬ ইমাম নিমভী বলেন, এর সনদ সহীহ, আসারুস সুনান ২৬৮ : ৯৪৪ ইবনে হাজার বলেন,সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য,আদ দিরায়া :১/২১৭)
অপর এক বর্ণনায় আছে ইবনে মাসঊদ (রা.) জুম’আর আগে চার রাক’আত এবং পরে চার রাক’আত পড়তেন। (মুসান্নফ আব্দুর রাজ্জাক ৩/২৪৭হা.৫৫২৪)
আবু আব্দুর রহমান আস সুলামী থেকে বর্ণিত আছে যে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. জুম’আর পূর্বে চার এবং পরে চার রাক’আত পড়তেন । অতঃপর আলী রা. চার রাক‘আতের পর আরো দুই রাক’আত পড়ার নির্দেশ দেন। (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক : ৩/২৪৭, ৫৫২৫)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)—এর আমল
বিভিন্ন সূত্রে ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত,
انه كان يصلى قبل الجمعة اربعا لايفصل بينهن بسلام
‘তিনি ক্বাবলাল জুম’আ চার রাক’আত পড়তেন, সালাম দিয়ে এর মধ্যে পৃথক করতেন না।’
(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ ২/৭৪ হা. ৬৬৩৬ তহাবী ১/৩৩৫ ইবনে হাজার ও আলবানীর গবেষণা অনুযায়ী এই হাদীসের সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। মু’জামু আসামী আর রুয়াত আলবানী— ৩/৪২০ তাকরীব : ৫২০/৬০৫৩ ইমাম নিমভী বলেন হাদীসটি সহীহ, আসারুস সুনান — ২৬৭)
৮. সাহাবাগণের ইজমা
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আমর ইবনে সায়ীদ ইবনে আস (রহ.) (৭০ হি.) বলেন,
كنت ارى اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فاذا زالت الشمس يوم الجمعة قاموا فصلوا اربعا
‘আমি রাসূলুল্লাহ (স.)—এর সাহাবাগণকে দেখতাম, জুম’আর দিন সূর্য হেলার পর তাঁরা দাঁড়িয়ে যেতেন এবং চার রাক’আত নামাজ পড়তেন। (আত তামহীদ : ৪/২৬ সনদ সহীহ এই বর্ণনাটি আবু বকর আছরামের উদ্ধৃতিতে ইবনে রজব হাম্বলী ফাতহুল বারী শরহে বোখারী : ৫/৫৪২ এ উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি অনেক তাবেয়ীর আমলও উল্লেখ করেছেন, তারা কাবলাল জুম’আ চার রাক’আত পড়তেন।
৯. তাবেয়ীদের আমল ও ইজ্মা
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইবরাহীম নাখয়ী (রহ.৯৫ হি.) বলেন,
كانوا يصلوا قبل الجمة اربعا
‘তারা ক্বাবলাল জুম’আ চার রাক’আত পড়তেন।’
(মুসান্নফ ইবনে আবী শাইবাহ : ৪/১১৫, ৫৪০৫)
ইবনে রজব হাম্বলী (রহ.) উল্লিখিত বর্ণনা সম্পর্কে লিখেন, বর্ণনাটির সনদ সহীহ। ইবনে খাইছামা (রহ.)—এর কিতাবুত তারিখের উদ্ধৃতিতে তিনি আরো বলেন, ইবরাহীম নাখয়ীর ভাষ্যমতে কাবলাল জুম’আ বিষয়ে তাদের ইজমা ছিল তা বুঝা যায়। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন, আমি যখন বলবো, তারা পড়তেন এর অর্থ হলো এর ওপর তাদের ইজমা ছিল। (ফাতহুল বারী : ৫/৫৪০)
বলাবাহুল্য ইবরাহীম নাখয়ী কুফার লোকদের অবস্থা বলছিলেন, আর কুফায় তখন অসংখ্য সাহাবা ও তবেয়ীর অবস্থান ছিল। তাই তারা পছন্দ করত এর মর্মই হলো এ বিষয়ে সমস্ত সাহাবা ও তাবেয়ীদের ইজমা ছিল। তারা সবাই কাবলাল জুম’আ চার রাক’আত পড়তেন।
মোটকথা, সার্বিকভাবে জুম’আর পূর্বে নামাজ পড়ার যথেষ্ট দলীল প্রমাণ রয়েছে। রয়েছে সাহাবা তাবেয়ীগণের আমল ও তাদের ঐক্যমত ও ইজমা। তারা জুম’আর পূর্বে বিভিন্ন পরিমাণে সাধ্যমতো নামাজ পড়তেন। তবে সূর্য হেলার পর চার রাক’আত ক্বাবলাল জুম’আ পড়তেন। তাই চার রাক’আত ক্বাবলাল জুম’আ পড়া তাদের নিয়মিত সুন্নত নামাজ। যারা তা অস্বীকার করে উপরোক্ত বিশুদ্ধ বর্ণনাগুলো অস্বীকার করছে তাদের মূর্খতা ও বাড়াবাড়ির কারণ মুসলিম বিশ্বকে অন্বেষণ করা প্রয়োজন। জনৈক বক্তাকে বলতে শুনেছি, জুম’আর চার রাক’আত, দুই রাক’আত কিছুই নেই, এই সব ফালতু কথা।
আপনারা বিবেচনা করেন, কেমন গোড়ামী থাকলে এমন মূর্খতার পরিচয় দিতে পারে। অস্বীকার করতে পারে এতো সব সহীহ হাদীস এবং সাহাবা, তাবেয়ীদের আমল। রাস্তা—ঘাট, হাট—বাজার ও ফেসবুকে এসব উন্মাদনাপূর্ণ বকওয়াস করে জনগণকে বিভ্রান্ত না করার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। সাথে সাথে বিজ্ঞ আলেমদের উপস্থিতিতে ইলমী আলোচনার জন্য আমি তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যে কোনো স্থানে বসুন, আমরা প্রস্তুত আছি। কিছু শুনামাত্র যাচাই না করে প্রচার করা মিথ্যুক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (সহীহ মুসলিম মুকাদ্দামাহ) তাই এসব অনৈতিকতা, অভদ্রতা,মূর্খতা এবং বিভাজন নীতি পরিহার করুন। পড়া লেখা করুন। নিজেই সব সমাধান পেয়ে যাবেন।
সংশয়ের অবসান
সংশয় এক.
জুম’আর পূর্বে নামাজ পড়ার কোনো দলীল নেই।
সমাধান : উপরোল্লিখিত আলোচনায় আশা করি সুস্পষ্ট হয়েছে তাদের এমন উক্তি অন্ধ বিশ্বাস ও মূর্খতার পরিচায়ক মাত্র।
সংশয় দুই.
জুম’আর আগে নামাজ পড়ার হাদীস জাল। এ মর্মে তারা ইবনে মাজাহ থেকে একটি বর্ণনা পেশ করে থাকে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত,
كان النبى صلى الله يركع قبل الجمعة اربعا لا يفصل فى شىيئ منهن
‘রাসূলুল্লাহ (স.) জুম’আর আগে চার রাক’আত পড়তেন, এর মধ্যে পৃথক করতেন না। (ইবনে মাজাহ : হাদীস : ১১২৯) কয়েকজন দুর্বল বর্ণনাকারীর কারণে এই বর্ণনাটি অতি দুর্বল।
সমাধান : ইবনে মাজাহ কিতাবে উল্লিখিত সনদটি অতিদুর্বল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে হাফিযুল হাদীসদের মতে এই হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে। ইমাম আবুল হাসান আল খিলায়ী (রহ.) (৪৯২ হি.) আল ফাওয়াইদ কিতাবে নির্ভরযোগ্য সনদে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এই বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ সা. জুমআর পরেও চার রাক‘আত পড়তেন। (তরহুত তাছরীব, আবু যুরআ ইরাকী — ৩/৩৬, দেখুন,ফয়জুল কাদীর মুনাভী — ৯/৪৮৭৫) সনদটি নিম্নরূপ
ابو اسحاق السبيعي عن عاصم بن ضمرة عن على عن النبى صلى الله عليه وسلم
মোটকথা,এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রমাণ হলো, রাসূলুল্লাহ (স.) ক্বাবলাল জুম’আ চার রাক’আত পড়েছেন,এই বর্ণনাটি সহীহ সনদেও বর্ণিত আছে। যারা এই হাদীসের সহীহ সনদটি উল্লেখ না করে শুধু বিতর্কিত সনদটি উল্লেখ করে তারা অবশ্যই খিয়ানত ও বিভ্রান্তিমূলক অপকর্মে লিপ্ত আছে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে আমরা এ বিষয়ে অনেকগুলো সহীহ হাদীস এবং সাহাবা, তাবেয়ীগণের আমল ও তাদের ইজমা উল্লেখ করেছি যা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।
সংশয় তিন. রাসূলুল্লাহ (স.) ও সাহাবাগণের যুগে জুম’আর আযান হতো একটি। আর আযানের সাথে সাথে খুৎবা শুরু হয়ে যেত। কোনো নামাজ পড়ার সুযোগ হতো না।
সমাধান : এ ধরনের সংশয় তাদের নিছক ধারণা। সাহাবাগণ তখনকার সময়ে সকাল থেকে মসজিদে সমবেত হতেন। সূর্য হেলার সাথে সাথে তারা চার রাক’আত নামাজ আদায় করতেন। যা ইতিমধ্যে বিশুদ্ধ সনদে আমরা উল্লেখ করেছি।
লেখক: গবেষক, বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
-কেএল