নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
নবুওতের ১১তম বছরে মহানবী সা. জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার জীবনে যখন তিনি অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েন। কেউ তার দাওয়াতি আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না। উল্টো তার প্রতি এবং তার সহচরদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন তীব্রভাবে নেমে এলো। এমনকি তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত; তখন নবীজিকে আল্লাহ তায়ালা বিষয়টি ওহির মাধ্যমে অবগত করেন।
তিনি পূর্ব প্রস্তুতি অনুসারে সফরসঙ্গী আবু বকর রা.-কে নিয়ে হিজরতের জন্য রওয়ানা করেন। এ হিজরত বাস্তবায়নে মহানবী সা. অনেক দূরদর্শী কর্মপন্থা অবলম্বন করেন।
আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল
আল্লাহ তায়ালার ওপর সত্যিকার তাওয়াক্কুল (ভরসা) এবং তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস মহানবি সা.-এর হিজরতকে করেছে সহজ সম্ভাবনাময়। তারপরও মানুষ হিসেবে সেটি ছিল অসম্ভব কঠিণ এক ভ্রমণ। কারণ এ ভ্রমণে ছিল বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও বিপদ। রাস্তা ছিল অপরিচিত। পেছনে শত্রু ছিল অনেক। পাথেয় ছিল সামান্য। গন্তব্য যেন কেউ জানতে না পারে এজন্য মহানবী সা. আল্লাহর ওপর ভরসা করার সঙ্গে সঙ্গে আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
আবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরতের অনুমতি
মহানবী সা. সাহাবায়ে কেরামকে প্রথমে আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দেন। অথচ সেটি ছিল অনেক দূরবর্তী এবং অপরিচিত একটি দেশ। সেখানের অধিবাসীরা ছিল দ্বীন বিরোধী।
কিন্তু মহানবী সা. আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে সাহাবিদের সেখানে হিজরতের অনুমতি দেন। দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন সেখানে অবশ্যই সাহায্য আসবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনি বলে দিয়েছেন, ‘আবিসিনিয়া ভূখণ্ডে একজন সম্রাট আছে যার কাছে কেউ জুলুমের শিকার হয় না। তোমরা সেদেশে চলে যাও, তোমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রশস্ততা ও নিষ্কৃতির পথ তৈরি করে দেওয়া পর্যন্ত। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২০৮)
নতুন পথে মদিনায় হিজরত
মদিনায় হিজরতের পথে মহানবি সা.-কে কয়েকদিন পর্যন্ত পশ্চাদ্বাবন করা হয়েছে। কোরাইশদের পুরষ্কারের লোভে অনেকেই খোঁজছিল নবীজিকে। এ ছাড়াও খাবারের সংকট এবং অপরিচিত রাস্তা ও পথ-ঘাটের কষ্ট তো ছিলই। পদে পদে এতসব বিপদ সত্ত্বেও নবীজি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে রওয়ানা হয়ে যান হিজরতের পথে।
উত্তম পরিকল্পনা
মদিনায় হিজরতের সিদ্ধান্ত নবীজি হঠাৎ করে গ্রহণ করেননি; বরং সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে চিন্তা করে এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মদিনায় কারা ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজ করবে তাদের প্রস্তুত করেছেন আগ থেকেই। এমনিভাবে আগেই সাহাবিদের হিজরতের অনুমতি প্রদান করেন। তাদের আগেই যদি নবীজি হিজরত করতেন তাহলে কোরাইশরা রয়ে যাওয়া অবশিষ্ট সাহাবিদের কোনোভাবেই মক্কা থেকে বের হতে দিত না। (জাওয়ামিউস সিরাহ, পৃষ্ঠা : ৬৬)
মক্কা থেকে বের হওয়ার আগেই তিনি সফরসঙ্গী, সময়, রাস্তা এবং বাহন নিয়ে ভাবতে ভুল করেননি। মক্কা থেকে বের হওয়ার পর কোরাইশদের খবরাখবর জানার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর রা. সেসব সংবাদের বাহক ছিলেন। হিজরতের পথে কোরাইশদের অবগতি তাকে পরবর্তী উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করত।
হিজরতের পথে পা বাড়ানোর আগেই তিনি পদপ্রদর্শক নির্ধারণ করে রাখেন। আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিত মক্কা-মদিনার রাস্তা ভালো চিনত। সেই এ কাজে সহায়তা করে।
মক্কার লোকেরা পায়ের ছাপে খুব পারদর্শী ছিল। আগে যাওয়া লোকের পায়ের ছাপ দেখে খুব সহজে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারত। এজন্য নবী সা. পায়ের ছাপ মুছে ফেলার জন্যও লোক নির্ধারণ করে রাখেন। এ কাজটি সম্পাদন করে আমের ইবনে ফুহাইরা। সে প্রতিদিন বকরির পাল নিয়ে নবীজির গুহার কাছে যেত। এতে করে খুব সহজেই নবীজি ও আবু বকরের পায়ের চিহ্ন মুছে যেত।
উত্তম সফরসঙ্গী নির্বাচন
নবীজিকে সব সাহাবিই ভালোবাসতেন। নিজেদের জান-প্রাণ উৎসর্গ করতে ছিলেন তৎপর। তবে হিজরতের পথে নবীজি এতসব সাহাবি থেকে আবু বকর রা.-কে নির্বাচন করেন সফরসঙ্গী হিসবে। কারণ আবু বকর রা. ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও মেধাবী।
আর তিনিও নবীজির সঙ্গে হিজরতের আকাঙ্খা পোষণ করছিলেন সেই কবে থেকে! তাছাড়া তিনি নিজের জান, মাল ও পরিবার-পরিজনকে হিজরতের জন্য খুব কাজে লাগিয়েছেন। সফরের আগে কোনো কিছু প্রকাশ করেননি কারও কাছে।
ধৈর্যের সঙ্গে অবিচলতা
হিজরতে মহানবী সা. পাহাড়সম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েই তিনি পরিবার-পরিজন ছেড়ে যেতে পেরেছিলেন। প্রিয় জন্মভূমি ত্যাগ করতে পেরেছিলেন এবং ক্ষুধা ও ভয় জয় করতে পেরেছিলেন হাসিমুখে।
নারীদের ভূমিকা
হিজরতে নারীদেরও ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আবু বকর কন্যা আসমা রা.-কে তার দাদা অর্থকড়ি ঘরে আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে দাদাকে প্রশান্ত করে বলেছিলেন, বাবা অনেক অর্থকড়ি রেখে গিয়েছেন। অথচ বাস্তবতা হলো তিনি কিছুই রেখে যাননি। এছাড়াও আসমা (রা.) প্রতিদিন নবীজি সা. ও বাবা আবু বকরের কাছে গুহায় খাবার নিয়ে যেতেন।
একদিন আবু জেহেল তাকে কিছুটা প্রহার করে। সেটার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন এ মহীয়সী নারী। কারণ আগেই তো তিনি হিজরতের পথের খাবারের থলে নিজের কোমরবন্ধনি দু টুকরো করে বেঁধে দিয়ে উৎসর্গ করেছেন নিজেকে। ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন ‘জাতুন-নিতাকাইন’ উপাধিতে।
লেখক: নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম ও মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।
-এটি