সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


যে কারণে মুসলিমদের কাছে মুহাররম মাস গুরুত্বপূর্ণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহিউদ্দিন মাসুম

গতকাল সন্ধ্যায় পবিত্র যুলহিজ্জাহ (যদিও লোকমুখে প্রসিদ্ধি পেয়েছে জিলহজ্জ নামে) মাসের ৩০ তারিখ শেষ হলো। সঙ্গে সঙ্গে শেষ হলো ১৪৪৩ হিজরি বছরও। আজ থেকে মুহাররম মাসের ১ তারিখ শুরু, সেই সঙ্গে শুরু ১৪৪৪ হিজরি সনও।

মুহাররম মাস বেশ কয়েকটি কারণে মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যথা : ০১. এটি কুরআনে ঘোষিত ৪টি ‘হারাম’ তথা সম্মানিত মাসের একটি (সুরা তাওবা: ৩৬), ০২. এই মাসটিকে হাদিসে আল্লাহ তায়ালার নিজের মাস (شهر الله المحرم) বলে নবিজি আখ্যা দিয়েছেন (সহিহ মুসলিম, ২/৮৬১), ০৩. প্রাচীনকালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরতি এ্যাক্ট অনুযায়ী যুদ্ধবিগ্রহে না-জড়ানোর জন্য নিষিদ্ধ সময়ের অন্তর্ভুক্ত মাস, ০৪. এই মাসের দশম তারিখ একটি ফযিলতপূর্ণ দিন যাকে 'আশুরা দিবস' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

এছাড়াও ঐতিহাসিক দিকে থেকেও মুহাররম মাসের দশম তারিখ গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি প্রসিদ্ধ কারণ তো হলো, এই দিনেই উম্মতে মুহাম্মদির জন্য হৃদয় বিদারক কারবালা ঘটনার অবতারণা হয়েছে। এছাড়াও আদম আ.-এর বহুল প্রার্থিত তাওবা কবুল, হযরত নুহ আ.-এর কিশতি প্রলয়ঙ্কারী ঝড় শেষে জুদি নামের পাহাড়ে নোঙর করা, মুসা আ. তাঁর অনুগত উম্মাতসহ নির্বিঘ্নে সমুদ্র পার হয়ে ফিরআউনের দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তি লাভ এবং ফিরআউনের সমুদ্রে সলীল সমাধি ঘটা, হযরত ঈসা আ.-এর জন্ম লাভের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এই দিনে ঘটেছে (মা সাবাতা বিস সুন্নাহ, হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.)।

এই মাসে সাওম রাখাসহ অন্যান্য নাফল আমল পালন করে ইবাদত করা ও গোনাহ থেকে বেঁচে থাকবার ‘বিশেষ শক্তি’ অর্জনের প্রতি কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা রয়েছে (সুরা তাওবা, ৩৬)।

আর এরসঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে শিক্ষা হিসেবে নিয়ে নিজের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানোর প্রচেষ্টা আমরা করতে পারি।
আমি এই পোস্টে দুটি বিষয় নিবেদন করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভূমিকা হিসেবে উপরের কথাগুলো উল্লেখ করলাম: ০১. হিজরি নতুন বছর শুরুর প্রাক্কালে আমার প্রথম নিবেদন, আমাদের জাতিসত্ত্বার স্বার্থে হিজরি সন-তারিখ হিসাব রাখার উপেক্ষিত ইসলামি সংস্কৃতিটি মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে চর্চিত হোক।

আমিরুল মুমিনিন হযরত উমার ইবনুল খত্তাব রা.-এর শাসনামলে সাহাবিদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে হিজরতকে স্মারক করে আল্লাহর মাস মুহাররম মাসকে প্রথম মাস ধরে মুসলিম উম্মাহর জন্য নিজস্ব ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করা হয়।

এটি আমাদের মুসলিমদের জাতিগত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সাওম, যাকাত, হজ্জ, ফিতরা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, কুরবানি এবং বালেগ হওয়ার বয়সসীমা নির্ধারণসহ শরিয়তের বহু বিধি-বিধান হিজরি সন-তারিখের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। বহুবিধ গুরুত্ব বিবেচনা করে আলেমগণ চান্দ্রবছরের হিসাব রাখাকে উম্মাহর জন্য ‘ফরজে কিফায়া’ বিধান সাব্যস্ত করেছেন।

পোপ অষ্টম গ্রেগরির anno domini (A.D.) বা যীশুখৃস্টকে উপাস্য বিশ্বাস করে প্রবর্তিত Christian calendar বা Gregorian calendar -যেটাকে আমার ইংরেজি সাল বা খ্রিস্টাব্দ হিসেবে চিনি- সেটির প্রতি অসতর্কতাবশত আগ্রহের বিপরীতে সাহাবিওয়ালা বিলুপ্তপ্রায় সুন্নাত তথা হিজরি সন-তারিখের হিসাব রাখার চর্চাকে উম্মাহর মাঝে ব্যাপকতা এনে দেওয়ার লক্ষ্যে আমাদের সচেতনতা ও সদিচ্ছা এ মুহূর্তে খুব জরুরি।
আমাদের আলেম ও তলাবাসমাজ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন।

০২. হিজরি নতুন বছরকে সামনে নিয়ে আমাদের কিছু ধার্মিক মানুষ, এমন কি কোনো কোনো আলেমের মাঝেও একটি আবেগধর্মী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সেটি হলো- আরবি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো।

একবার ইমাম আবু হানিফা রা.-এর দাদা তাঁর পিতাকে হযরত আলী রা.-এর কাছে হিজরি নববর্ষের কিছু উপহারসহ নিয়ে গিয়েছিলেন। আলী রা. তাঁর নববর্ষ উদযাপনের প্রবণতা দেখে বললেন: نوروزنا كل يومٍ আমাদের জন্য প্রতিটা দিনই নববর্ষ, নতুন দিন। অর্থাৎ একজন মুমিনের জন্য প্রতিটা দিনই নতুন এবং প্রতিটি নতুন দিনেই সে নব উদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। তার সেই নব উদ্যম আনার জন্য একটি বছরের দিকে তাকিয়ে থাকা নির্বুদ্ধিতা বৈ কিছুই নয়।

রসুল স. দিনের শুরুতে যখন সূর্যের উদয় হত, তিনি দোয়া করতেন: الحمد لله الذي أقالنا يومنا هذا ولم يهلكنا بذنوبنا. অর্থাৎ সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি আমাকে এই দিনটি ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং আমাকে আমার অপরাধগুলোর কারণে ধ্বংস করে দেননি।

প্রতিটি রাতেই ঘুমের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মৃত্যু দান করেন আবার যাদেরকে ইচ্ছা ঘুম থেকে জাগ্রত করার মাধ্যমে মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার করেন নতুন জীবন দান করেন (সুরা যুমার : ৪২, সুরা আনআম : ৬০)। অতএব প্রতিটি দিনই মানুষের জন্য নতুন দিন, নতুন সুযোগ।

ইসলামের একটি বড় সৌন্দর্য হলো, এর কোনো শিক্ষা বা বিধান অর্থহীন নয়। প্রতিটি বিষয়ই ব্যক্তি, তার সমাজ বা জাতীয় জীবনের জন্য অর্থবহ কর্ম হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ইসলামের আরেকটি বড় সৌন্দর্য হলো, ইবাদত থেকে শুরু করে অভ্যাস-আচরণ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে সাংস্কৃতিকভাবে একজন অনুগত মুমিনকে ইসলাম স্বয়ংসম্পূর্ণ করে দিয়েছে, কোনো ক্ষেত্রেই তাকে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী করে রাখেনি। এজন্য জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই অন্য জাতি-ধর্মের আচার-সংস্কৃতির অনুসরণ করার সুযোগ একজন মুমিনের নেই। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমের সুরা আলে ইমরানের 85 নম্বর আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

ইসলামে নববর্ষ, বর্ষপূর্তি, জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি পালন-উদযাপনের কোনো সুযোগ নেই। এগুলো আমরা অন্যান্য ধর্ম বা জাতির আচার-সংস্কৃতি থেকে ধার করে এনে আমাদের জীবনাচারে ঢুকিয়ে দিয়েছি। হাদিসে অন্য ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সরাসরি অনুসরণকে ‘তাশাব্বুহ’ বলে, যা স্পষ্টভাবে হারাম। আর ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সঙ্গে সাদৃশ্যতাপূর্ণ আচরণকে ‘মুশাবাহাত’ বলে, যা অবশ্যই নিন্দনীয় ও পরিত্যজ্য।

সহিহ বুখারি, ২/৭০৪, ৪/১৭২২ ; সহিহ মুসলিম, ২/৭৯৬, ফাতহুল বারি লি ইবনি হাজার, ১০/২৮২। নববর্ষে শুভেচ্ছা জানানো বা কোনোভাবেই নববর্ষ পালন-উদযাপন করা হয়ত ‘তাশাব্বুহ’ না-হলেও ‘মুশাবাহাত’ হবে নিশ্চয়।

পূর্ববর্তী উম্মাহর ধ্বংসের বড় একটি কারণ ছিল- আল্লাহ প্রদত্ত দীন-বিধানের মধ্যে মনগড়া পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিকৃতসাধন। ইসলামি শরিয়ার মধ্যে অন্য জাতি-ধর্মের রীতি-পদ্ধতি ও সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ শরিয়ার মধ্যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং বিকৃতসাধন ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমরা একটি নতুন বছর আগমনের বার্তা অন্যকে জানাতে পারি, কিন্তু কোনোমতেই ভিনজাতির অনুকরণে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো, কার্ড পাঠানো বা উপহার দেওয়ার সংস্কৃতির অনুসরণ করতে পারি না।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ