আবদুল কাইয়ুম শেখ।।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে শক্তি, সামর্থ্য, মেধা, বুদ্ধি, হাত ও পা দিয়েছেন সৎ পথে উপার্জন করার জন্য। পরিশ্রম করে হালাল পথে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য। হালাল পথের উপার্জনেই রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা। আর হারাম পথের উপার্জনে রয়েছে অসম্মান ও অমর্যাদা। হালাল পন্থায় উপার্জন করায় রয়েছে পার্থিব সম্মান ও বন্দনা। অপরদিকে হারাম পন্থায় উপার্জন করায় রয়েছে পরকালীন লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা। হালাল পন্থায় উপার্জন করার উৎসাহ কুরআন-হাদিসে প্রদান করা হয়েছে। পক্ষান্তরে হারাম হতে বিরত থাকার জোর নির্দেশ মহান আল্লাহ প্রদান করেছেন। তাই আলোচ্য নিবন্ধে আমরা হারাম পন্থায় উপার্জন করার কদর্যতা, ভয়াবহতা ও পরিণাম সম্পর্কে প্রমাণসহ আলোকপাত করছি!
হারাম উপার্জন ঘৃণ্য
হারাম পন্থায় উপার্জন করা ঘৃণ্য, মন্দ ও নিন্দনীয়। হারাম উপায়ে উপার্জনকারী ব্যক্তিরা ঘৃণার্হ, তুচ্ছ, হীন, নীচ ও অধম। হারাম পন্থায় উপার্জন করার কারণে অধিকাংশ সময় অন্যের হক নষ্ট হয়। অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন, হরণ ও আত্মসাৎ করা হয়। অন্যকে ঠকানো হয়। এগুলোর সবই অকল্যাণকর, নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য কাজ। হারাম উপায়ে উপার্জনকে নিতান্ত মন্দ কর্ম আখ্যায়িত করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'আর আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, দৌড়ে দৌড়ে পাপে, সীমালঙ্ঘনে এবং হারাম ভক্ষণে পতিত হয়। তারা অত্যন্ত মন্দ কাজ করছে। দরবেশ ও আলেমরা কেন তাদেরকে পাপ কথা বলতে এবং হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করে না? তারা খুবই মন্দ কাজ করছে।' (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৬২-৬৩)
সম্পদের হিসাবদান
বহু লোক হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। বহুবিধ উপায়ে মানুষকে ঠকানোর কারণে রাতারাতি তাদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাসের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসায়। তবে এসব লোককে মনে রাখতে হবে এই জীবন শেষ জীবন নয়। এই জীবনের পর অবিনশ্বর অন্য এক জীবন রয়েছে। সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে তার পুংখানুপুংখ হিসাব সেই জীবনে প্রদান করতে হবে। সম্পদের যথাযথ হিসাব দেওয়ার পূর্বে কারো পা চুল পরিমাণ নাড়াতে পারবে না। 'হজরত আবু বারজা আসলামি রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামত দিবসে কোন বান্দার পদযুগল এতটুকুও সরবে না, যে পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ না করা হবে : কোথা হতে তার ধন-সম্পদ উপার্জন করেছে ও কোন কোন খাতে ব্যয় করেছে?' (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৭)
হারামখোর জাহান্নামে যাবে
হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদের মাধ্যমে হারামখোর ব্যক্তি যদিও সাময়িকভাবে সুখী হয়। বাহ্যিক আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করতে থাকে। কিন্তু হারাম ভক্ষণ পরকালে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। হারাম খাওয়ার কারণে তাকে নরকের আগুনে প্রজ্জ্বলিত হতে হবে। দোজখের সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। হারাম সম্পদের মাধ্যমে দেহের যে অংশটুকু পরিপুষ্ট হয় তা জাহান্নামে যাবে। 'হজরত জাবের রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম মালে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম মালে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামই সমীচীন।’ (মুসনাদে আহমাদ) অপর একটি হাদিসে এসেছে, 'হজরত আবু বকর রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এমন দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না যাকে হারাম খাবার দ্বারা পরিপুষ্ট করা হয়েছে।' (সহিহ তারগিব, ১৭৩০)
হারামখোর জান্নাতে যাবে না
হারাম পন্থায় যারা উপার্জন করে তারা অনেক সময়ই অন্যের অধিকার নষ্ট করে। মানুষের হক বিনষ্ট করে। এক্ষেত্রে তারা কসম খেতেও দ্বিধাবোধ করে না। অথচ কসমের মাধ্যমে যদি কোন ব্যক্তি কারো হক নষ্ট করে, তাহলে সেই ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব এবং জান্নাত হারাম হয়ে যায়। তাই অন্যের হক নষ্ট করার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া নিতান্ত জরুরি। 'হজরত আবু উমামাহ রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কসমের মাধ্যমে কোন মুসলিমের হক নষ্ট করে তার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম ওয়াজিব করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! অতি সামান্য বস্তু হলেও? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বাবলা গাছের মত এক ধরনের কাঁটাযুক্ত গাছের ডাল হলেও এ শাস্তি দেওয়া হবে।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫০)
ধোঁকাবাজ পরিত্যাজ্য
হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জনকারী ব্যক্তিরা অনেক সময়ই ধোঁকাবাজি, ধাপ্পাবাজি ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। প্রতারণা, শঠতা ও কূটকৌশলের মাধ্যমে মানুষকে ঠকানোর কাজ আঞ্জাম দেয়। এসব লোক নামে মুসলমান হলেও তাদের কাজ অমুসলিমদের মতো। প্রতারক ও প্রবঞ্চক লোকদের সঙ্গে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। 'হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য শস্যের একটি স্তুপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি স্তুপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন ফলে হাতের আঙল গুলো ভিজে গেল। তিনি বললেন, হে স্তুপের মালিক! এ কী ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি লেগেছে। তিনি বললেন, সেগুলো তুমি স্তুপের ওপরে রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারতো। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে, আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮৫)
মিথ্যায় বরকত নষ্ট
ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে খুব কম ব্যবসায়ীই এমন আছে যারা মিথ্যা কথা বলে না। কম দামি জিনিসকে বেশি দামি বলে চালিয়ে দেয় না। মানসম্পন্ন নয় এমন জিনিসকেও তারা মানসম্পন্ন বলে আখ্যায়িত করে। ক্রেতা কোন দাম বললে ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বলে, এই দামে আমি কিনতেও পারি নি। এ জাতীয় মিথ্যা বলে তারা অধিক মুনাফা অর্জন করতে চায়। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে মিথ্যা বলা হলে বরকত নষ্ট হয়ে যায়। তাই ব্যবসায়ী সমাজের জন্য সমীচীন হলো ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার মিথ্যা কথা বর্জন করে চলা। 'হজরত হাকিম ইবনু হিজাম রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের উভয়ের ইচ্ছাধিকার থাকবে। যদি তারা উভয়ে সত্য কথা বলে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি যথাযথ বর্ণনা করে তবে তাদের কেনা বেচায় বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যা বলে ও ত্রুটি গোপন করে, তবে তাদের কেনা বেচার বরকত নষ্ট হয়ে যাবে।' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১১০) তাই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মঙ্গল বিবেচনায় হালাল পথে উপার্জন করায় মনোনিবেশ করা প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য একান্ত জরুরি।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১
-এএ