।।মুফতি সাদেকুর রহমান।।
মানব মুক্তির দিশা দিতে এ ধরায় আগমন ঘটেছিল লাখো নবী- রাসুলের। সেই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আবির্ভূত হয়েছিলেন দুজাহানের সরদার, নবিকুল শিরোমণি, মোহাম্মদ আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।তার জীবনের ২৩টি বছর চরম ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট মোজাহাদার ভেতর দিয়ে কাটিয়েছিলেন।
হাজারো জুলুম- নির্যাতনের সামনে পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে অবিচল ছিলেন ।তার সেই মিশনের সমাপ্তি ঘটেছিল বিদায় হজের এক ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে। যে ভাষণে তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারিত করেছিলেন প্রতিটি মানুষের জান, মাল ইজ্জত -আবরুর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কথা, নারীর অধিকার সমুন্নত করার কথা, সকল প্রকারের অন্যায় ,হানাহানি- মারামারি ও জুলুম- নির্যাতন বিদূরিত করে এক শান্তিময় ও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের কথা, সমাজ থেকে সুদের ভয়াল থাবা কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার কথা।
সর্বোপরি সকল বৈষম্যবাদ বিদূরিত করে ইনসাফ ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার কথা। পাঠক সমীপে সেই ভাষণের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো
১. হে জনতা, আমার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনো, আমি জানি না, এবারের পর তোমাদের সঙ্গে এ জায়গায় আর একত্র হতে পারব কি না।
২. হে মানবসকল, স্মরণ রাখো, তোমাদের আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। তোমাদের আদি পিতা একজন, অনারবদের ওপর আরবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তদ্রূপ সাদার ওপর কালোর কোনো প্রাধান্য নেই। আল্লাহ ভীতিই শুধু শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার মানদণ্ড।
৩. তোমাদের পরস্পরের রক্ত ও ধন-সম্পদ আজকের দিন, এ মাস এবং এ শহরের মতো পবিত্র। ৪. শোনো, জাহেলিয়াতের সব কিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের রক্তের দাবিও রহিত করা হলো।
৫. জাহেলি যুগের সুদ রহিত করা হলো। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি রহিত করছি তা হলো, আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সুদ। এখন থেকে সব ধরনের সুদ হারাম করা হলো।
৬. স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা আল্লাহর আমানতস্বরূপ তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কলেমার মাধ্যমে হালাল করা হয়েছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে যে তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে স্থান দেবে না, যাদের তোমরা পছন্দ করো না।
তারা এরূপ করলে প্রহার করতে পারো। তবে কঠোর প্রহার করবে না। তোমাদের ওপর তাদের অধিকার হলো, তোমরা যথাযথ অন্ন-বস্ত্র প্রদান করবে।
৭. আমি তোমাদের কাছে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অন্যটি হলো আমার সুন্নাহ।
৮. হে জনতা, মনে রেখো, আমার পরে কোনো নবী নেই। তোমাদের পরে কোনো উম্মত নেই। ফলে তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, রমজানের রোজা রাখবে, স্বেচ্ছায় ধন-সম্পদের জাকাত দেবে, আল্লাহর ঘরে হজ করবে, শাসকের আনুগত্য করবে।
যদি তোমরা এসব পালন করো, তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে (ইবনে মাজাহ)।
৯. হে লোক সকল, পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী হবে না এবং পুত্রের অপরাধে কোনো পিতাকে দায়ী করা হবেনা
১১. প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। তোমরা তোমাদের দাস-দাসী সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরও তা পরতে দেবে। তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। শাস্তি দেবে না।
১২. হে মানবজাতি, ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। কেননা অতীতের অনেক জাতি এ বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব হবে আমার এ কথাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
মহানবী (সাঃ) ভাষণ শেষ করলেন। এবং তাঁর চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি করুণ স্বরে করুণভাবে আকাশ পানে তাকালেন এবং তিনি বললেন, ‘হে মহান প্রভু! হে পরওয়ার দিগার! আমি কি তোমার দীনের দাওয়াত পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। তখন উপস্থিত জনতা সবাই সম্মিলিতভাবে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আপনার দীন পরিপূর্ণভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন।‘ তখন তিনি আবার বললেন যে, ‘হে প্রভু! আপনি শুনুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এরা বলেছে আমি আপনার দীনকে লোকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি।‘
ভাবের আতিশয্যে নবী নীরব হলেন। জান্নাতি নূরে তাঁর চেহারা আলোকদীপ্ত হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে কুরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়। ‘আজকের এই দিনে তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’
হযরত রাসূল (সাঃ) কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। জনতাও নীরব। কিছুক্ষণ পর হযরত (সাঃ) জনতার দিকে তাকালেন এবং করুণ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বিদায় বন্ধুগণ, বিদায়।
হজরত রাবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালফ জনতার কাছে উচ্চকণ্ঠে বিদায় হজ্জের ভাষণ এর বাণী পৌঁছে দেন (ইবনে হিশাম)।
(আল-কোরআন, পারা: ৬, সূরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৩)। (বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা; সীরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম (র.), খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২৭৩-২৭৭; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর (র.), খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ১৯৮ ও ৩২০-৩৪২, ই. ফা. বা.)।
লেখক: মুশরিফ, ফাতওয়া বিভাগ, শেখ জনূরুদ্দীন র. দারুল কুরআন মাদ্রাসা, চৌধুরীপাড়া, ঢাকা।
-কেএল