এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ: কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। প্রত্যেকটা ইবাদতের মধ্যেই রয়েছে মহৎ শিক্ষা। তাই এটি যেমন ইবাদত ঠিক তেমনি শিক্ষা। এতে নানা রয়েছে মুমিনগণের জন্য শিক্ষা ও তাৎপর্য । একটু চিন্তা করে দেখি, আমরা অধিকাংশ মানুষ কুরবানি করি। মোটাতাজা হৃষ্টপুষ্ট পশু জবেহ করি। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করি। কিন্তু এই কুরবানি থেকে আমরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করি না। আমাদের কুরবানি শুধু লৌকিকতায়পূর্ণ, লোক দেখানো কুরবানিকে আমরা পছন্দ করি। আমরা শুধু পশু কুরবানি করি : কিন্তু আমরা কখনও মনের পশুকে কুরবানি করি না। আর আমরা মনের পশুকে কুরবানি করি না বলেই লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে কুরবানি করার পরও আমাদের আদর্শের কোন পরিবর্তন হয় না। একজন মুসলমান কুরবানি করবে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই। তাই একজন মুসলমান এই কুরবানি থেকেই শিক্ষা নিবে যে কুরবানি মাধ্যমে আমরা কি হাসিল করছি। কুরবানি আমাদের কি বলতে এসেছে। কুরবানির মেসেজ কি?
নিম্নে কুরআন ও হাদিসের আলোকে কুরবানির শিক্ষা নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোকপাতের করা হইলো।
• ত্যাগ ও উৎসর্গ শিক্ষাঃ- আমাদের উপর ইসলামের যে বিধানই আরোপ করা হোক, তা আমাদের পালন করতে হবে। আল্লাহর রাজি-খুশির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে।
হযরত ইসমাইল আ. হযরত ইবরাহীম আ. এর অত্যন্ত প্রিয় সন্তান ছিলেন। স্বপ্নের মতো সাজানো পুত্র। দুরন্ত নেক সন্তান। তবুও, যখন আল্লাহ বললেন তোমার প্রিয় সন্তানকে জবেহ করো। ইবরাহিম আঃ আদেশ পালনে কোন অলসেমি প্রদর্শন করলেন না।
বরং আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সুতরাং আমাদের শিক্ষা হলো ইসলামের জন্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যথাসম্ভব ত্যাগ স্বীকার করা।
• শুদ্ধ নিয়ত ও তাকওয়া শিক্ষাঃ- নিয়ত ও তাকওয়া সবার আগে। শুদ্ধ নিয়ত ও তাকওয়া ছাড়া সবকিছুই ভালো জিনিসও খারাপ হতে পারে। নিয়ত ও তাকওয়ার কারণে গুণেই কাজ ভালো বা খারাপ হবে। আল্লাহ কুরবানী প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না উহার (জন্তুর) গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩৭)।
উপরোক্ত আয়াত থেকে জানতে পারলাম যে, গরু বা ছাগল যত বড়ই হোক, সেইটা গ্রহণ করবেননা। গ্রহণ করবেন শুদ্ধ নিয়ত ও তাকওয়া। সুতরাং আমাদের শিক্ষা প্রতিটি কাজে শুদ্ধ নিয়ত ও তাকওয়া থাকা আবশ্যক।
• সবরের শিক্ষাঃ- আমরা যদি সফল হতে চাই। সফলতা অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদেরকে সবর অর্থাৎ ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। আমাদের সফলতার পথে বা জান্নাতের পথে নানা বাঁধা আছে।এইযে ধরে নিন—নাফছানি, খাহেশাত, দুষ্ট মানুষ, কঠিন পরিবেশ ও প্রতিবেশ, সবই আমাদের রাজপথের কাঁটা। বাঁধ। এসব কাঁটা উপেক্ষা করেই আছে সফলতার উন্মুক্ত দ্বার।
প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কর্তৃক জবাই করার আদেশ মানতে ইবরাহীম আ. এরও সবর করতে হয়েছে। ইবরাহীম আঃ সত্যি সত্যি জবেহ করতে উদ্যত না হয়ে, মিছামিছি অভিনয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সত্যতার সাথে সবর করেছেন। সুতরাং আমাদের শিক্ষা প্রতিটি কাজে সবর অর্থাৎ ধৈর্য্য ধারণ করা
• শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষাঃ আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাহকে যে কোন আদেশ দিতে পারেন। কেননা তিনি জীবনদাতা এবং তিনি মৃতুদানকারী। তিনিই প্রতিপালক ও তিনিই সবকিছু। তাই বান্দাহ তার আদেশ পালন করতে বাধ্য। আর এই আনুগত্য হবে শর্তহীন। আল্লাহর আদেশ সহজ হোক আর কঠিন হোক তা পালন করার বিষয়ে একই মন-মানসিকতা থাকতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে মায়া-মমতা প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না।
কুরআনুল কারীম আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আনুগত্যের চরম পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছিলেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। তিনি বলতে পারতেন যে, হে আল্লাহ! তোমার জন্য আগুনে গিয়েছি, ঘরবাড়ি ছেড়েছি, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু হারিয়েছি, এসব কিছুর বিনিময়ে আমার স্নেহের সন্তানটিকে কুরবানী করা থেকে রেহাই দাও। কিন্তু তা তিনি করেননি; বরং আল্লাহ হুকুম করেছেন তা শর্হহীনভাবে মেনে নিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহর আনুগত্য পালনের ব্যাপারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সুতরাং আমাদের শিক্ষা রবের শর্তহীন আনুগত্য করা।
• আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার শিক্ষা :- প্রত্যেক ইবাদতই আল্লাহর শেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। তাই কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়। যেমন, আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : আল্লাহ তোমাদের সহজ চান, কঠিন চান না, আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করতে পারো এবং তিনি তোমাদেরকে যে, হিদায়াত দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর। (বাকারাহ : ১৮৫)
উপরোক্ত আয়াতে জানা যায়, কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
সুতরাং আমাদের শিক্ষা কুরবানিকে গুরুত্বের সহিত পালন করা এবং এই শ্রেষ্ঠত্বের শুকুর আদায় করা।
• অধীনস্তদের প্রতি দায়িত্বের শিক্ষাঃ- কুরবানীর শিক্ষা হলো নিজে আল্লাহর বিধান মেনেই ক্ষান্ত নয় বরং নিজের অধীনস্তদেরকেও আল্লাহর বিধানের প্রতি তাগিদ দিতে হবে। তাদেরকে মানতে বাধ্য করতে হবে, অন্যথায় পরকালে মুক্তি পাওয়া যাবেনা। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবীজি বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই তার অধীনস্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। অন্যদিকে ইবরাহীম আঃ তার ছেলেকে জবেহ করতে আদিষ্ট হয়েছিলেন। আদেশটা ছিল তার ছেলে সম্পর্কে। তিনি যেমন রবের আদেশে উদ্বুদ্ধ ছিলেন তার সন্তানও ঠিক তেমনি আগ্রহী ছিলেন। পিতা ও পুত্রের সম্মিলিত আমল। যদি ইসলাম শুধু নিজ ব্যক্তি সত্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে জবাই করার মত বিষয় নবী হয়ে ইবরাহীম আঃ আদেশ পালন করতেন না। অথচ তিনি বিনা সংশয়ে আদেশ পালন করেছেন।
এর থেকে বুঝা যায়, ব্যক্তির ক্ষেত্রে তো বটেই, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের ইসলামি বিধানও পালন করতে হবে। সুতরাং আমাদের শিক্ষা পরিবার ও সমাজকে আল্লাহর বিধানের দাওয়াত দিতে হবে।
• পরামর্শ ও সাম্য-সামাজিকতার শিক্ষা:- ইসলাম একটি শ্রেষ্ঠ ধর্ম। রবের কাছে মনোনীত জীবন বিধান। সুস্পষ্ট লাইফস্টাইল। তাই সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। সাম্য- সামাজিকতা ও পরামর্শে ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান রয়েছে অনন্য। কেননা এগুলো না থাকলে সুশীল সমাজ কায়েম হবে না।
হযরত ইবরাহীম আঃ যখন ইসমাইল আঃ কে জবেহ করার বিষয়ে আদেশ দেওয়া হলো। তিনি নবী, আদেশ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি চাইলে একাই কাজ সম্পূর্ণ করতে পারতেন।কিন্তু তিনি প্রয়োগের আগে ছেলের অনুমতি নিয়েছেন “বাবা আমি তো স্বপ্নে দেখেছি, আল্লাহ আদেশ করেছেন, যাতে তোমাকে জবাই করি, তুমি কি বল বাবা?” এই তো দায়িত্বশীলদের অধীনস্তদের সাথে সম্পর্ক, অনুমতি ও পরামর্শ!
হাদিস শরীফে এসেছে, প্রথমে কুরবানীর গোশত তিনদিনের বেশী জমিয়ে রাখার অনুমতি ছিলো না। কেন ছিলোনা? যাতে মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়বোধ গড়ে উঠে, নিজের ভাইকে ক্ষুধার্ত রেখে আপনি যে খেতে পারবেননা, এই শিক্ষা দেবার জন্যই তিনদিনের বেশী জমিয়ে রাখার অনুমতি ছিলোনা। পরে যখন সবার মধ্যে সামাজিক সাম্য ও দায়িত্ববোধ গড়ে উঠে, তখন বেশীদিন জমিয়ে রাখার অনুমতি দেয়া হয়। সুতরাং আমাদের শিক্ষা সামাজিক যোগাযোগ,সম্পর্কে এবং দায় ও দায়িত্ববোধে ইসলামের শিক্ষার প্রতি লক্ষ্য রাখা।
পরিশেষে আল্লাহ তা'য়ালা আমাকে কুরবানিকে কবুল করুন। কুরবানির শিক্ষা জেনে ও বুঝে গ্রহন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক, কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক।
-কেএল