সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


হজের আত্মশুদ্ধি ও জিলহজের প্রথম দশকের গুরুত্ব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শায়খ ড. বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা ।। এসে গেছে হজের মৌসুম। বইছে হজের হাওয়া। উড়ছে হজের পতাকা। এই তো দয়াময়ের মেহমান দল। আল্লাহর আদেশ পালনের তাওফিকপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা।

তাইতো বেরিয়ে পড়েছেন পায়ে হেঁটে ও বাহনে চড়ে। ধরেছেন তারা হেদায়েত ও ধার্মিকতার পথ। পেয়ে গেছেন অভিনন্দন ও পরম চাওয়া। আল্লাহর সাহায্য তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। ‘নিঃসন্দেহে প্রথম ঘর যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল, তাতো মক্কায়, যা বরকতমন্ডিত এবং সারা জাহানের জন্য পথপ্রদর্শক।

তাতে সুস্পষ্ট নিদের্শনাবলি রয়েছে (যেমন) মাকামে ইবরাহি। যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ হবে। আল্লাহর জন্য ওই ঘরে হজ করা লোকেদের ওপর আবশ্যক যার সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে এবং যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, (সে জেনে রাখুক) নিঃসন্দেহে আল্লাহ বিশ্বজাহানের মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭)

হজ ইসলামের একটি বড় স্তম্ভ এবং এক বিশাল জমায়েত। হজ একটি পবিত্র সফর এবং ভালোবাসার এক সুবাস। একে ঘিরে থাকে ইবাদত, তাকওয়া ও জিকির। হজ শুদ্ধি, পুণ্য ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম।

এর মাধ্যমে হয় মহান স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের নবায়ন। হয় শপথ ও সংকল্পের মজবুতায়ন। ইবাদতগুলোর মধ্যে হজ একটি দামি ও শ্রেষ্ঠ পুণ্যকর্ম। একটি উচ্চাঙ্গের উৎসবমুখর ইবাদত। এর ফজিলত হিসেবে তো এটাই যথেষ্ট যে এটি পাপসমূহের কাফফারা এবং এর প্রতিদান জান্নাত।

নবীজি সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশে হজ করল এবং অশালীন কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত রইল, সে নবজাতক শিশু, যাকে তার মা এ মুহূর্তেই প্রসব করেছে, তার মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।’

তিনি আরো বলেন, ‘মকবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (হাদিস দুটি বর্ণিত হয়েছে বুখারি ও মুসলিমে) অন্য হাদিসে এসেছে— রাসুল সা.-কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘কোন আমলটি উত্তম?’ তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান আনা। প্রশ্ন করা হল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।

প্রশ্ন করা হলো, তারপর কোনটি। তিনি বললেন, মাবরুর হজ।’ (বর্ণনায় মুসলিম) ‘মাবরুর’ হলো সেই— হজ যার সবকিছু বিধি মোতাবেক সম্পন্ন হয় এবং তাতে কোনো গুনাহর সংশ্লেষ না থাকে।

আল্লাহর বান্দারা, যে কেউ ইবাদতগুলোতে বোধের দৃষ্টিতে তাকাবেন, তিনি জানবেন— ইবাদত কিছু আচার অনুসরণ করা যা ভেতরগত অনুগত্য তুলে ধরে। যার লক্ষ্য অন্তর পরিশুদ্ধ করা, ক্বলব সংশোধন করা এবং তাকে আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত করা। আর সেসব ইবাদতেরই অন্যতম হজ। চমৎকার সব শিক্ষা ও উপকারী সব তাৎপর্যে ভরা এই হজ। অথচ কিছু মানুষের কাছ থেকে এসব বিষয় উধাও হয়ে গেছে। তারা হজের বাহ্যিক দিকগুলোকে আঁকড়ে ধরেছে আর প্রাণ ও দামি দিকগুলোকে বরবাদ করে দিয়েছে।

হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও তাৎপর্য হলো তাওহিদ এবং তাঁর প্রতি নিষ্ঠা বাস্তবায়ন করা। সম্মানিত কাবাঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাওহিদের ওপর। ভিত্তি রাখা হয়েছে হেদায়েতের ওপর।

এটি নির্মাণ করেছেন নবীদের পিতা ও তাওহিদপন্থীদের নেতা ইবরাহিম (আ.)। এতে তাঁকে আদেশ দেয়া হয়েছিল আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করতে। তার কাজকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে। আদেশ দেয়া হয়েছিল একে আল্লাহর নামে প্রতিষ্ঠা করতে। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন: ‘আর স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহিমকে সে ঘরের (বায়তুল্লাহর) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, ‘আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না এবং আমার ঘরকে পাক-সাফ রাখবে তাওয়াফকারী, রুকু-সিজদা ও দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীদের জন্য’।’ (সুরা হজ: ২৮)
ইবরাহিম ও পুত্র ইসমাঈল (আ.) কাবা নির্মাণের পর এই প্রার্থনা করেন: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত জাতি বানান।’ (সুরা বাকারা: ১২৮)

হজের কার্যক্রম ও আনুষ্ঠানিকতাগুলো তাওহিদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহতে সমর্পন ও তাঁর বশ্যতা স্বীকার, তাঁর ওপর ভরসা ও বিনয় প্রদর্শন এবং সব কিছুকে বাদ দিয়ে শুধু তাঁরই ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে হজ তাওহিদকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করে। সুরা হজের হজ সংক্রান্ত আয়াতগুলোর মধ্যে রয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘সুতরাং মূর্তিপুজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর। আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয়ে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক না করে। আর যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোনো জায়গায় নিক্ষেপ করল।’ (সুরা হজ: ৩০-৩১)

অতএব মুসলিম একমাত্র আল্লাহরই অভিমুখী হবে। তার জন্য বৈধ নয় আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে দোয়া করা, কারো মাধ্যম গ্রহণ করা, কারো কাছে নিজের প্রয়োজন তুলে ধরা কিংবা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য কোনো আমল নিজ উপাস্য আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সম্পাদন করা।

হজের মাধ্যমে আত্মা মুক্ত হয় পঙ্কিলতা থেকে। প্রশিক্ষিত হয় পবিত্রতা ও মহানতায়। প্রশিক্ষিত হয় আল্লাহর ভয়ে। অভ্যস্ত হয় ইবাদতে। তৈরি হয় উত্তম আচরণ ও মহৎ আচার-ব্যবহার। ‘হজ হয় কয়েকটি নির্দিষ্ট মাসে, অতঃপর এ মাসগুলোতে যে কেউ হজ করার মনস্থ করবে, তার জন্য হজের মধ্যে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭)

মুসলিমরা, হজে মানবিক একতা ও ঈমানি ভ্রাতৃত্বের চিত্র ফুটে উঠে। যার আদেশ আমাদের আল্লাহ দিয়েছেন এই বলে: ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩) অপর বাণী: ‘আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)।’ (সুরা রুম: ৩১-৩২) অন্যত্র বলেছেন: ‘নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’ (সুরা হুজুরাত : ১০)

একইভাবে তাঁর নবী (সা.) বিদায় হজে বলেছেন: ‘হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো! আরবির ওপর অনারবির এবং অনারবির ওপর আরবির, কৃষ্ণকায়ের ওপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের ওপর কৃষ্ণকায়ের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতেই।’

হায়, আজ মুসলিমদের কতই না প্রয়োজন এই মহান শিক্ষা ধারণ করা। এই মহান লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ