সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


জিলহজ মাসের আমলসমূহ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আলহাজ হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুল হক চাঁদ দেখাঃ-হিজরী সন গণনা করা হয় চান্দ্র মাসের হিসেব অনুযায়ী। এর সাথে আমাদের ধর্মীয় অনেক বিষয় জড়িত। অনেক আমল শুদ্ধ হওয়া না হওয়া এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

যেমন: রোযা,হজ,যাকাত,ঈদ,কুরবানী ইত্যাদি। এ কারণে চান্দ্র মাসের হিসেব রাখা মুসলমানদের জন্য ফারযে কিফায়া ঘোষনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এটা এমন একটা আমল যার সাথে সমস্ত মুসলমান জড়িত, মুসলমানদের আমল জড়িত। মুসলমানদের একটি দল যদি এর হিসেব রাখে, তাহলে সবার পক্ষ থেকে ফারযের জিম্মাদারী আদায় হয়ে যাবে।

আর যদি কেউ হিসেব না রাখে তাহলে ফারয পরিত্যাগ করায় সকলে গোনাহগার হবে। চাঁদের হিসাব এত জরুরী যে, যদি একদিন কমবেশি হয় তবে রোযা হজ¦,ঈদ প্রভৃতি ইবাদতে আমরা অনেক অসুবিধা আর বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হবো। ইসলামী শরীয়তে চান্দ্রমাসের হিসাবই গ্রহনযোগ্য। চাঁদ ইসলামী ইবাদতের অবলম্বন। তাই চাঁদ এক হিসেবে ইসলামের প্রতীক বা শেআরে ইসলাম। চাঁদ দেখা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, লোকেরা আপনাকে নতুন মাসের চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে।

বলে দিন যে, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজে¦র সময় ঠিক করার মাধ্যম (সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ১৮৯)। (২) রাতে ইবাদত এবং দিনে রোযা রাখাঃ- বছরের ১২টি মাসের মধ্যে ৪টি মাস বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন।

এই চার মাসের অন্যতম হলো জিলহজ মাস। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি, আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টির দিন থেকে। তারমধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান, সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না (সূরাঃ তাওবা, আয়াতঃ৩৬)।

জিলহজ মাস মানে হজের মাস। এ মাসেই হজে¦র মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। অর্থাৎ যদিও হজের ৩টি মাস তথা শাওয়াল, যিলকদ ও জিলহজ। কিন্তু জিলহজের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত হজের মূল আমল পালন করতে হয়। জিলহজ আসলে আমলের মাস। বিশেষকরে এ মাসের প্রথম দশ দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ফযীলতপূর্ণ।

কুরআনুল কারীমে সূরা ফরজ-এ আল্লাহপাক জিলহজ মাসের দশ রাত্রির কসম করে ইরশাদ করেন, “শপথ ফজরের ও শপথ দশ রাত্রির” এর দ্বারা রাব্বুল আলামীন জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের ফযীলত বুঝিয়েছেন।

হযরত ইবনে আব্বাসের মতে, আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আঃ)-কে একমাস আল্লাহর ধ্যানমগ্ন থাকার পর আরো দশ দিন বৃদ্ধি করতে বলেছিলেন তা ছিল এই দশ দিন। হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, জিলহজের দশদিন সর্বোত্তম দিন। (মাআরিফুল কুরআন) মুহাদ্দিসিনে কেরাম বলেন, দিন হিসেবে জিলহজের প্রথম দশদিন উত্তম।

কেননা এতে আরাফার দিন রয়েছে। আর রাত হিসেবে রমজানের শেষ দশক উত্তম। কারণ তাতে লাইলাতুল কদর নিহিত। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালার নিকট জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের ইবাদত অপেক্ষা অধিক পছন্দনীয় আর কোন ইবাদত নেই। এর এক দিনের রোযা এক বছরের রমজানের সমতুল্য।

আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের সমতুল্য। বিশেষভাবে ৯তারিখ আরাফার রোযা। আমি আল্লাহর দরবারে আশা রাখি, আরাফার দিবসে রোযা রাখলে তিনি পূর্ববতী ও পরবর্তী বছরের গোনাহ মাফ করে দিবেন (সুনানে তিরমিজি)।

(৩) নখ,চুল ইত্যাদি না কাটাঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে ইয়াওমুল আযহাকে (১০ই জিলহজকে) ঈদের (কুরবানীর) দিন হিসেবে নির্ধারণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আর দিনটিকে এই উম্মতের জন্যই আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেছেন।

এক সাহাবী আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি উক্ত দিনে মনীহা (দুধ পান করার জন্য অন্যের কাছ থেকে ধার করা পশু) ছাড়া আর কিছু না পাই তাহলে কি উহাই কুরবানী করবো? নবীজি (সাঃ) বললেন, না-তা করবে না।

কারণ পশুটির মালিকই তো তুমি না। তবে তুমি দশ তারিখে ঈদের নামাযান্তে তোমার চুল ও নখ কাটবে, তোমরা গোঁফ খাট করবে, আর নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করবে, তাহলেই তুমি আল্লাহর কাছে কুরবানীর পরিপূর্ণ সাওয়াব পেয়ে যাবে (আবু দাউদ)। এ সম্পর্কিত আরেকটি হাদিস হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফরমান, যখন তোমরা জিলহজ মাসের চাঁদ উঠতে দেখবে, তখন তোমাদের মধ্যে হতে যে কুরবানী করার ইচ্ছা রাখে সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে পশু যবাই করার আগ পর্যন্ত (সহীহ মুসলিম)।

উভয় হাদিসকে মিলালে এই আমলটি কুরবানীদাতা এবং যার কুরবানী নেই সকলের জন্যই সাব্যস্ত হয়। তাই উত্তম হলো, জিলহজ মাসের চাঁদ উঠার ২/১দিন আগেই হাত পায়ের নখ, বগলের পশম নাভীর নিচের লোম এবং মোচ ইত্যাদি কর্তন করা । আর চাঁদ উঠার পর থেকে সেগুলো কর্তন না করে ১০ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করা।

অতঃপর ১০তারিখে ঈদের নামাযান্তে কুরবানীর পশু যবাই করে সেগুলো কাটা মুস্তাহাব। (৪) তাকবীরে তাশরীক পড়াঃ- ৯ই জিলহজের ফজর থেকে ১৩ই জিলহজের আসর নামায পর্যন্ত সর্বমোট ২৩ওয়াক্তে, ঈদের নামায ধরলে ২৪ওয়াক্তে প্রত্যেক ফরয নামাযের সালাম ফিরানোর পর একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব।

জামাআতে নামায হোক বা একাকী সর্বাবস্থায়ে বলতে হবে। পুরুষ হোক অথবা নারী সকলকেই বলতে হবে। পুুরুষরা উচ্চস্বরে আর মহিলারা নিম্নস্বরে পড়বে। তাকবীরে তাশরীক এইঃ- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। (অর্থঃ আল্লাহ সবচেয়ে বড় আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই আর আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড় এবং সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য)।

তাকবীরে তাশরীকের ইতিহাসঃ- তাকবীরে তাশরীক্ব আল্লাহর তিনজন সম্মানিত ও নৈকট্যপ্রাপ্ত নবী, রাসূল ও ফেরেশতার মুখনিঃসৃত বানী। হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন সজোরে সুতীক্ষè ছুরি হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর গলায় চালানো শুরু করলেন, এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে আসমান থেকে দুম্বা নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে এ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন আল্লাহর কুরবানী দেখলেন, তখন তিনি বলে উঠলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। আর ইসমাঈল (আঃ) যখন দেখলেন তার পরিবর্তে দুম্বা যবাই হয়ে গেছে তখন তিনি ‘আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ” বললেন। এভাবে তিনজনের যিকিরকে একত্রিত করে পরিপূর্ণ তাকবীরে তাশরীক্ব করা হয়েছে। (শামী) (৫) হজ পালন করাঃ- হজ ইসলামের অন্যতম একটি রোকন।

সুতরাং যাদের উপর হজ ফরয হয়েছে তাদেরকে অবশ্যই হজ পালন করতে হবে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কবুল হজের বদলা একমাত্র জান্নাত। (বুখারী, মুসলিম) অন্যত্র বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ করে এবং হজের প্রাক্কালে অশ্লীল কথা, কাজ ও পাপ থেকে বিরত থাকে, সে নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। (বুখারী ও মুসলিম) হজ আদায়কারী ৮ই জিলহজ ইহরাম অবস্থায় তালবিয়া পড়তে পড়তে মিনায় যাবে।

সেখানে যোহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজর পড়বে। ৯ই জিলহজ ফজর পড়ে সূর্যোদয়ের পর আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আরাফায় যোহর ও আসর পড়বে এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুআ-দরূদ-ইস্তেগফার তালবিয়া পাঠ করতে থাকবে। সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামায না পড়েই মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও ইশা এক আযান ও এক ইকামাতে আদায় করবে।

রাত সেখানেই কাটাবে। এখান থেকেই ৭০টি কংকর সংগ্রহ করবে। মুযদালিফায় ফজরের নামায পড়ে একটু ফর্সা হলে আবার মিনায় আসবে। মিনায় এসে শুধু বড় জামারায় ৭টি কংকর মারবে। এরপর যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে কুরবানী করে হলক বা কসর করে হালাল হয়ে যাবে।

তারপর তাওয়াফে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কায় যাবে এবং যথারীতি তাওয়াফে যিয়ারত সেরে, সায়ী করে মিনায় ফিরবে। সেখানে ১১ ও ১২ই জিলহজ পরপর তিন শয়তানকে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করবে ব্যস হজ সম্পন্ন হয়ে গেল। বাকী থাকল শুধু বিদায়ী তাওয়াফ যা আদায় করা ওয়াজিব।

(৬) ঈদের রাতে ইবাদত করাঃ- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাতে জাগরিত থেকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকবে, তাহলে যেদিন অন্যান্য দিল মরে যাবে সেদিন তার দিল মরবে না, অর্থাৎ কিয়ামতের দিনের আতংকের কারণে অন্যান্য লোকের অন্তর ঘাবড়ে গিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যাবে, কিন্তু দুই ঈদের রাত্রে জাগরণকারীর অন্তর তখন ঠিক থাকবে-ঘাবড়াবে না। (ইবনে মাজাহ) (৭) কুরবানীর দিনের সন্নাতসমূহ আদায় করাঃ- (ক) খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা।

(খ) ফজরের নামায মহল্লার মসজিদে পড়া। (গ) মেছওয়াক করা। (ঘ) গোসল করা। (ঙ) শরীয়ত অনুমোদিত পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করা। (চ) সাধ্যমত উত্তম পোষাক পরিধান করা। (ছ) আতর সুগন্ধি ব্যবহার করা।

(জ) কোন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া। (ঝ) সর্ব প্রথম কুবানীর গোস্তু হতে খাওয়া। (ঞ) ঈদের নামায (ওযর না থাকলে) মসজিদে না পড়ে ঈদের মাঠে পড়া। (ট) ওযর না থাকলে ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। (ঠ) উচ্চস্বরে তাকবীর পড়তে পড়তে ঈদগাহ পর্যন্ত যাওয়া। (ড) এক রাস্তায় ঈদগাহে যাওয়া, অন্য রাস্তায় প্রত্যাবর্তন করা। (ঢ) সকাল সকালে ঈদগাহে যাওয়া।

(ণ) ঈদুল আজহার নামায যথা সম্ভব সকাল সকালে পড়া। (বেহেস্তী গাওহার)। (৮) ঈদের নামাযঃ- ১০ই জিলহজ ২রাকাত শোকরানা নামায পড়া ওয়াজিব। যাকে ঈদুল আযহার নামায বলা হয়।

ঈদের নামায পড়ার নিয়মঃ- প্রথমে নিয়ত করবে “আমি আল্লাহর ওয়াস্তে ঈদুল আযহার দুই রাকাআত ওয়াজিব নামায ছয় তাকবীরের সহিত এই ইমামের পিছনে পড়ছি” অতঃপর “আল্লাহু আকবার” বলে হাত বাঁধবে এবং ছানা পড়ে তিনবার এই নিয়মে “আল্লাহু আকবার” বলবে যে, প্রতিবার “আল্লাহু আকবার” বলার সময় উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠাবে।

আর প্রতিবার “আল্লাহ আকবার” বলার পর এতটুকু সময় অপেক্ষা করবে, যে সময়ে তিনবার “সুবহানাল্লাহ” বলা যায় এবং ১ম ও ২য় তাকবীরের পর হাত বাঁধবে না বরং ৩য় তাকবীরের পর হাত বাঁধবে।

অন্য জেহরী নামাযের ন্যায় সূরা কেরাআত পড়ে ১ম রাকাআত শেষ করে ২য় রাকাআতে কেরাআতের পর্ব শেষ করবে। অতঃপর ১ম রাকাআতের নিয়মানুসারে তিনটি তাকবীর বলবে এবং প্রতি তাকবীরের পর হাত ছেড়ে দিবে। এর পর ৪র্থ তাকবীর বলে রুকুতে যাবে।

এভাবে নামায শেষ করে ইমাম মেম্বারে দাঁড়িয়ে খুৎবা আরম্ভ করবে তবে জুমআর নামাযের ন্যায় মেম্বরে উঠে প্রথমে একটু বসবে না বরং দুই খুৎবার মাঝে একটু বসবে। আর ঈদের নামাযে ১ম রাকাআতে “সূরা আ’লা” ও ২য় রাকাআতে “সূরা গাশিয়া” পড়া সুন্নাত। (ফাতোয়া আলমগীরি-১/১৫০)।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ