হাফেজ মাওলানা আব্দুল মাজীদ মামুন রাহমানী আমার ইউটিউব চ্যানেল amm Islamic tv তে "সর্বনিম্ন কত টাকা থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে?" এই শিরোনামে একটি ভিডিও আপলোড করেছিলাম।
এক ভাই কমেন্টে লিখেছেন কুরবানী ওয়াজিব কোথায় আছে, রেফারেন্স সহ জানাবেন। তাই এ বিষয়ে একটু লেখা। কুরআন-সুন্নাহর Strong document বা মজবুত দলিল এবং উম্মতে মুসলিমার ধারাবাহিক আমল দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, কুরবানী করা ওয়াজিব তথা বাধ্যতামূলক। Capable বা সামর্থ্যবান ব্যক্তি কুরবানি না করলে গোনাহগার হবে। এবিষয়ে ধারাবাহিক কয়েকটি দলিল পেশ করব, ইনশাল্লাহ....
১. আল্লাহ তায়ালা বলেন- إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ ﴿١﴾ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ﴿٢﴾ অর্থ:- নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার:১-২)
এই আয়াতের Correct explanation বা সঠিক ব্যাখ্যা হলো, হে রাসূল! আপনাকে আমি ‘কাউসার’ নামক নেয়ামত দান করেছি। তাই আপনি ঈদের নামায আদায় করুন একমাত্র আপনার প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য। ‘নাহর’ তথা কুরবানী করুন ঐ প্রভুর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এবং তাঁরই নামে। আল্লাহর এই নির্দেশের কারণে ঈদের নামায যেমন ওয়াজিব, কুরবানিও ওয়াজিব।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, সঠিক তাফসীর হচ্ছে- (و انحر) এর অর্থ: কুরবানী করুন। আর সালাত দ্বারা ঈদের নামায উদ্দেশ্য। এটাই যুগ যুগ ধরে বহু সালাফের কথা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু,আতা, মুজাহিদ,ইকরিমা,ক্বাতাদাহ ও হাসান বসরী রহ.সহ বহু জগৎ বিখ্যাত তাফসীর বিশেষজ্ঞগণ وانحر এর অর্থ "আপনি কুরবানী করুন" করেছেন। তাফসীরে ইবনে কাসীর,৮/৫০৩
আল্লামা আলূসী রহ. তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলেন:- অধিকাংশ মুফাসসিরীনে কেরামের মতে এই আয়াতে نحر দ্বারা কুরবানী করা উদ্দেশ্য। তাফসীরে রুহুল মাআনী،১৪/৬৬৫,৬৬৬
ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহ. বলেন: فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ﴿٢﴾ এর সঠিক অর্থ হচ্ছে হে রাসুল! আপনি আপনার নামাযকে খালিস আপনার রবের জন্য পড়ুন,Statues বা মূর্তি-গাইরুল্লাহর জন্য নয় (যেমন মুশফিকরা করে থাকে)। ঠিক তেমনিভাবে আপনার কুরবানী ও খালিস রবের নামে করুন। অন্য কোন প্রতিমা ও মূর্তির নামে নয়।জামিউল বায়ান ফী তা'বীলিল কুরআন লিত্তবারি,১৬/৩৬১,৩৬২
এ সকল তাফসীর দ্বারা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে সূরা কাউসারের ২ নং আয়াতে বর্ণিত نحر দ্বারা কুরবানী করাই উদ্দেশ্য। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ নির্দেশ পালন অবশ্যই ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
২. সূরা হজের ৩৪ নং আয়াতে কুরবানীকে আল্লাহ তা'আলা সকল উম্মতের জন্য Assigned বা ধার্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:- وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ অর্থ:- আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া Quadrupeds বা চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।… (সূরা হজ্জ-৩৪)
এমন আমল যা সকল উম্মতের জন্য Inevitable বা অবধারিত তা অবশ্যই ওয়াজিব হওয়ার-ই প্রমাণ বহন করে। ৩. কুরআনুল কারীমে একাধিক জায়গায় কুরবানীকে নামাযের সাথে Added বা যুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন:-قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
অর্থ: আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। (সূরা আনআম-১৬২)
এতে একথা প্রমাণ হয় যে, নামায যেমন আবশ্যকীয়, কুরবানীও তাই। অতএব, কুরবানী ওয়াজিব বলেই সাব্যস্ত হবে।
৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদিসে “ضحوا” বলে কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলের Extensive order বা ব্যাপক আদেশ দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, কুরবানী ওয়াজিব। মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-২৭১১৭; আসসুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী, হাদীস নং-১৯৫৪৯; আল মু'জামুল কাবীর লিত্ত্ববরানী, হাদীস নং- ২১৫১৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস নং-২৪২৬৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদীস নং-৮১৪৪
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের "সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কুরবানি করবে না’ তাদের প্রতি ঈদগাহে না আসার Warning বা হুশিয়ারি উচ্চারণও প্রমাণ করে কুরবানি ওয়াজিব। এরশাদ হচ্ছে...
"যে ব্যক্তি Affordability বা সামর্থ্য থাকা সত্তেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে।" সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ৩১২৩ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং- ৮০৭৪
৬. যারা ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী দিয়েছে তাদেরকে রাসূল স. পুনরায় কুরবানী আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। যা প্রমাণ করে কুরবানী ওয়াজিব ও আবশ্যকীয় আমল।
যেমন হযরত বারা ইবনে আযিব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তার মামা আবু বুরদা ইবনে নিয়ার (রাযিঃ) নবী (ﷺ) এর যবেহ এর আগে যবেহ করলেন এবং বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আজকের দিনে গোশত তলব করা ভাল নয়। তাই আমি আমার Family kin বা পরিবার-পরিজন, Neighborhood বা পাড়া-প্রতিবেশী ও নিজ গৃহের লোকদেরকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি কুরবানী করেছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ তুমি পুনরায় কুরবানী কর।
তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার নিকট একটি Little goat বা ছোট বকরি আছে যা দুধের বয়স অতিক্রম করেছে, যেটি গোশতের দু’টি বকরীর চাইতেও উত্তম। তিনি বললেনঃ এটাই তোমার উত্তম কুরবানী হবে। আর তুমি ছাড়া অন্য কারো জন্য জাযাআ (ছয় মাসের বকরী) যথেষ্ট হবে না। সহীহ মুসলিম,হাদীস নং- ৪৯১০
একবার কুরবানি করার পর তা right time বা সঠিক সময়ে না হওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম তার সাহাবীকে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন এবং তার কাছে কুরবানীর উপযুক্ত বকরি না থাকা সত্ত্বেও কম বয়সের বকরি দ্বারা হলেও কুরবানি করার নির্দেশ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, কুরবানি ওয়াজিব; মুস্তাহাব নয়।
৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরীফে দশ বছর অবস্থানকালে কুরবানি করে গেছেন। তিরমিজি ১৫০৭, মুসনাদে আহমদ ৪৯৩৫।
আর শরীয়তের Principles বা মূলনীতি হচ্ছে- যে কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধারাবাহিকভাবে করেছেন কোনো দিন ছাড়েননি তখন কাজটি ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে। তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম শরহু মুসলিম,৩/৩০৯
৮. জাবালা ইবনু সুহাইম (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ- এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-কে কুরবানী প্রসঙ্গে প্রশ্ন করল, এটা কি ওয়াজিব। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানী করেছেন এবং মুসলমানগণও (কুরবানী করেছেন)। সে আবার (একই বিষয়ে) প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, তুমি কি বুঝেছো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানী করেছেন এবং মুসলমানগণও।
তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং- ১৫০৬; ইবনে মাজাহ শরীফ, হাদীস নং- ৩১২৪; মেশকাত শরীফ হাদীস নং- ১৪৭৫
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানি হাফি. তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিমে বলেন:- ইবনে উমর রা. এর জবাবে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ারই Hint বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেননা, তাঁকে কুরবানি ওয়াজিব কি-না? এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। যদি সত্যিই কুরবানি ওয়াজিব না হতো, তবে তিনি স্পষ্ট ওয়াজিব নয় বলতে পারতেন। তিনি তা না করে রাসূল স. এর আমলের Continuity বা ধারাবাহিকতার কথা উল্লেখ করেছেন, যা ওয়াজিব হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। আর স্পষ্ট ওয়াজিব বলেননি যাতে কেউ ফরজ ভেবে না বসে। তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম শরহু মুসলিম ৩/৩০৯
৯. মিখনাফ বিন সুলাইমান রা. হতে বর্ণিতঃ- তিনি বলেন, আমরা আরাফাতের ময়দানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঊকুফ করছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করেন, হে লোক সকল! প্রত্যেক পরিবারের Master বা কর্তার উপর প্রতি বছর কুরবানী করা আবশ্যক।
সুনানে তিরমিযি,হাদীস নং-১৫১৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৭৮৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং-৪২২৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং- ৩১৩৫; মেশকাত শরীফ, হাদীস নং- ১৪৭৮
এ হাদীসে উল্লিখিতيَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِى كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً ا এর মধ্যকার "على" শব্দ এজাতীয় ক্ষেত্রে Compulsory বা বাধ্যতামূলক বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। যার অর্থ দাঁড়ায় কমপক্ষে ওয়াজিব।
১০.শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অভিমতঃ- শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়া দিয়েছেন কুরবানী করা ওয়াজিব। তিনি তাঁর এই বিখ্যাত ফাতাওয়ায় কুরআনের বহু আয়াতের উপর ভিত্তি করে কুরবানী ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন।
তিনি বলেন...
واما الاضحية ، فالأظهر وجوبها ، فانها من اعظم شعائر الاسلام وهي النسك العام في جميع الامصار، والنسك مقرون بالصلاة في قوله : قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ .
وقد قال تعالى: فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ. فامر
بالنحر كما امر بالصلاة.
وقد قال الله تعالى: * وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ
* والْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ ۖ
* لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ ۗ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ .
অর্থাৎ কুরবানী যে ওয়াজিব, তা দলিলের বিচারে সর্বাধিক স্পষ্ট মত। তার কারণ- এক. কুরবানি হচ্ছে ইসলামের সর্ববৃহৎ ও ব্যাপক নিদর্শন। এটা গোটা উম্মতের জন্য ওয়াজিব হওয়ার-ই দাবী রাখে।
দুই. কুরবানিকে আল্লাহ তায়ালা নামাযের সাথে যুক্ত করেই পেশ করেছেন। যেমন সূরা আনআমের ১৬২নং আয়াতে রয়েছে: নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী একমাত্র রাব্বুল আলামীনের জন্য।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে কুরবানী করার নির্দেশ করেছেন। তাঁর নির্দেশ মান্য করা ওয়াজিব। সূরা কাওসার এর দুই নং আয়াতে নামায ও কুরবানী উভয়ের জন্য আদেশ এসেছে। তাই নামায যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি কুরবানিও।
সূরা হজ্জের ৩৪, ৩৬, ৩৭ এ তিনটি আয়াতেও আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট পশু জবাই করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মাজমুআতুল ফাতাওয়া লিইবনে তাইমিয়া,১২/৯৩
-এটি