মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম খলিল: নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন, রহমাতুল্লিল আলামিন। গোটা সৃষ্টি জীবের জন্য রহমত। তিনি মহান চরিত্রের অধিকারী।
ইজ্জত- সম্মানের কোন কমতি তার মাঝে নেই। সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে আল্লাহ তাআলা তাকে মুক্ত রেখেছেন। শুধু তাকে নয়; বরং সকল নবী রাসূলগণই সকল ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত। অসত্য- অনাচার, অন্যায়-অবিচার, হিংসা-বিদ্বেষ, কৃপণতা, কপটতাসহ সবধরনের পাপ-পঙ্কিলতার লেশমাত্র তাদের মাঝে নেই। আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে তাদেরকে মুক্ত রেখেছেন।
প্রেরণ করেছেন মাসুম বা নিষ্পাপ হিসেবে। তাইতো আল্লাহ তাআলা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে বিশ্ববাসীর জন্য অনুপম আদর্শ রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ -তার জন্য যে আল্লাহ, আখেরাতকে কামনা করে থাকে এবং আল্লাহকে অনেক স্মরণ করে। (সূরা আহযাব, আয়াত: ২১)
নবীজির ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করা ঈমানের মৌলিক অংশ। জীবিত অবস্থায় যেমনিভাবে তাকে কষ্ট দেওয়া হারাম ছিল তেমনি ভাবে মৃত্যুর পরেও তার সম্মানহানি হয় এরকম কথা বা কাজ করা হারাম। আল্লাহ তা'আলা বলেন, নবীকে কষ্ট দেওয়া তোমাদের জন্য জায়েজ নয় এবং এটাও জায়েজ নয় যে, তার ইন্তেকালের পর তোমরা তাঁর স্ত্রীদের বিয়ে করবে।
আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা গরুতর ব্যাপার। (সূরা আহযাব, আয়াত: ২২) যারা নবীজিকে কষ্ট দিবে, তারা দুনিয়াতেও শাস্তি ভোগ করবে আর আখেরাতে তো রয়েছে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত আক্রোশ বা আপন স্বার্থের কারণে কাউকে শাস্তি দেননি।
তার রক্ত ঝড়েছে তায়েফে। ঝড়েছে ওহুদে। শহীদ হয়েছে তার দান্দান মোবারক। তার প্রতি বিদ্বেষবশত কাফেররা উটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত তার উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। এত কিছুর পরও তিনি সকলকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কারণ তিনি রহমাতুল্লিল আলামিন। নবীজির ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করা মুসলিমদের উপর আবশ্যকীয় দায়িত্ব। কারণ তার ইজ্জত-সম্মান এর ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করা মানে আল্লাহর ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করা। কেননা তিনি হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি।
তার নির্বাচিত নবী ও রাসুল। অন্যদিকে নবীজির সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বিরূপ কথাবার্তা বললে এক চুল পরিমানও ছাড় দেওয়া হবে না। কারণ তিনি হলেন মানবজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তার সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে কথা বললে মুসলিমদের আকিদা-বিশ্বাসে ফাটল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা সাধারণ মুসলিমদের জন্য অনেক ক্ষতিকর।
আবার তার সম্মান নিয়ে মন্তব্য করা মানে কোরআন ও হাদিসের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা। কারণ কোরআন ও হাদিসে তিনি মাসুম বা নিষ্পাপ হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন। এতদসংক্রান্ত কারণে মুসলিমদের উপর আবশ্যক নবীজির সম্মান ও মর্যাদাকে রক্ষা করা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জীবদ্দশায়ই যারা তার চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করেছিল, তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি বলেছেন, তারা কাবার গিলাফ ধরে জড়িয়ে থাকলেও তাদেরকে ক্ষমা করা হবে না। এটা তার ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে ছিলনা; বরং তা ছিল আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের স্বার্থে।
নবী অবমাননার শাস্তি কোরআনে: আল্লাহ তা'আলা বলেন, নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে" কষ্ট দেয়, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের প্রতি লানত করেন। পরকালে তাদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত রাখেন।" (সূরা আহযাব, আয়াত:৫৭) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়। তাদের প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে। তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব। (আসসরিমুল মাসলূল আলাশাতিমির রাসূল: ১৭) কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, "যে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়।
তার আনীত দ্বীন সম্পর্কে বিদ্রুপ করে অথবা তার ব্যক্তিসত্তা, বংশমর্যাদা বা তার চারিত্রিক গুণাবলীতে কালিমা লেপন, বা অন্য কোন এমন পন্থা অবলম্বন করে যাতে তার প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, স্পষ্ট বা ইঙ্গিতে অবমাননা হয় সে কুফুরি করল। আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি দুনিয়া ও আখেরাতে অভিসম্পাত করেন। তার জন্য জাহান্নামে শাস্তি প্রস্তুত রাখেন। (তাফসীরে মাযহারী: ৫/৫৬০)
আল্লামা ইদ্রিস কান্দলভী রহ. তার বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ সীরাতে মোস্তফাতে লিখেছেন, "জ্ঞানীদের নিকট এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কটুক্তি করা। তাকে গালমন্দ করা। তাকে নিয়ে ঠাট্টা- বিদ্রুপ করা ও তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো তাকে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নের অপরাধের চেয়ে জঘন্য।
কারণ এটা সর্বস্বীকৃত যে, রাষ্ট্র অনেক বড় বড় অপরাধীকেও ক্ষমা করতে পারে। কিন্তু যে রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা উপরাষ্ট্র প্রধানের শানে বেয়াদবি করে। তার অবমাননা করে। রাষ্ট্র তাকে কখনও ক্ষমা করেনা। অন্যথায় রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা এবং সম্মান অটুট থাকবে না। আর রাসূলের অবমাননা শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধানের অবমাননার মতো নয়; বরং গোটা উম্মতকে অবমাননার নামান্তর। তাই উম্মতের প্রত্যেক সদস্যের নৈতিক কর্তব্য হলো, যখনই কোন কুলাঙ্গার নবীজির অবমাননা করে তখনোই তার প্রাণ ছিনিয়ে নিবে। নতুবা নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দিবে। (সীরাতে মুস্তফা: ৩/৪৭)
নবী অবমাননার শাস্তি হাদিসে: ইমাম শাবী রহ. হযরত আলী রা. হতে বর্ণনা করেন, জনৈকা ইয়াহুদী নারী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গালমন্দ করত এবং তার দুর্নাম করত।
তখন এক ব্যক্তি তাকে শ্বাসরোধে মেরে ফেলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রক্তকে মূল্যহীন ঘোষণা করলেন। (সুনানে আবী দাউদ, হাদিস: ৪৩৬২) এই হাদীসটি উল্লেখ করে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.বলেন, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দ করার অপরাধে কোন নারীকে হত্যা করা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীসটি স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।
এমনিভাবে তাতে কোন জিম্মিকে, এমনকি কোন গালমন্দকারী মুসলিম নারী বা পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কারণ, হাদীসে বর্ণিত নারী মদিনা সনদের আওতাভুক্ত জিম্মি ছিল।(আসসরিমুল মাসলূল আলাশাতিমির রাসূল: ৪১) মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, "ওমর রা. এর দরবারে এমন এক ব্যক্তিকে আনা হলো যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিয়েছে। ওমর রা. তাকে হত্যা করেন।
অতঃপর বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা বা কোন নবীকে গালি দিবে তোমরা তাকে হত্যা করো।" (আসসরিমুল মাসলূল আলাশাতিমির রাসূল) আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইজ্জত-সম্মান ও মর্যাদাকে রক্ষা করার কাজে শরিক রাখুন। আল্লাহ তাআলার পরে তাকে জীবনের সবকিছু থেকে বেশি ভালোবাসার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মুদাররিস: মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস তেজকুনিপাড়া, তেজগাঁও, ঢাকা
-এটি