মুফতি মুহাম্মাদ ইবরাহীম খলিল।।
আমাদের নবীজি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলমাত্র শেষ নবী এবং সর্বোত্তম ব্যক্তিত্বই নন। বরং তিনি সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সর্বকালের আদর্শ, মুক্তিদূত ও পথপ্রদর্শক।
মানবতার সর্বোত্তম জীবনাদর্শের প্রতিচ্ছবি। তার আদর্শ কেবল এক ক্ষেত্রে নয়, জীবনে চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে তার আদর্শের সামগ্রীতা স্বীস্বীকৃত। দৈনন্দিন জীবনে ভালো ব্যবহার। আদর্শ পরিবার গঠন। দরিদ্র ও অসহায়দের সঙ্গে হৃদ্রতা প্রদর্শন। বিচার কার্যে ইনসাফ। জিহাদ ও যুদ্ধের ময়দানে দুর্দমনীয় বীরত্ব। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।
ন্যায়পরাণতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের উজ্জল দৃষ্টান্ত সহ ইত্যাদি মহত্তোম গুণের অধিকারী তিনি। তার আচার-আচরণ চালচলন অত্যন্ত সৎ, নমনীয় ও কোমল ছিল। তিনি জীবনে কোন মুসলমান কিংবা কাফেরের সাথেও কটাক্ষপূর্ণ ও কটু আচরণ করেননি। মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে বলেন, তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (সূরা কলাম: আয়াত ৪)।
সারাবিশ্বেই চলছে আজ মুসলমানদের উপর সীমাহীন শোষণ ও নিপীড়ন। সর্বত্র চলছে অশান্তির আগুন। তাই নতুন করে শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলতে এবং সর্বত্র ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের বিকল্প নেই। পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা অপর এক জায়গায় তার নবী সম্পর্কে বলেন যারা আল্লাহ ও তার শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে রয়েছে উত্তম নমুনা (সূরা আহযাব: আয়াত ২১)।
তিনি সকল কালে, সকল দেশে সকল মানুষের জন্য সমান কার্যকর ও কল্যাণময়। অনেকে মনে করেন বর্তমানের আধুনিক যুগে তথাকথিত সুশীল সমাজে তিনি কীভাবে আদর্শ হবেন? আমি বলবো আপনারা নবীজির সিরাত এবং তার জীবনাচার মনোযোগের সাথে পড়েন। সবকিছুই পেয়ে যাবেন। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত একজন মানুষের চাল-চলন ও উঠাবসা থেকে নিয়ে শুরু করে জীবনের সকল দিক তার মাঝে পাবেন। মানবতার সকল সমস্যার সমাধান তিনি দিয়ে গেছেন। আমাদের শুধু জানার অভাব।
তার জীবনী যারা মনোযোগের সাথে উধ্যয়ন করেছে এবং তার আদর্শকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে লালন করেছে ও তাকে সফলতার মানদণ্ড হিসেবে মেনেছে তারাই সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছে।
বার্নাডশ, মরিস বুকাইলি, উইলিয়াম পিকথল, লিওটলস্টয়, পন্ডিত নেহেরু সহ অসংখ্য বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও মনীষী তার জীবনী অধ্যায়ন করে তার আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানবতার মুক্তির জন্য এই আদর্শের উপযোগিতা সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন মন্তব্য করে নিজেরা ধন্য হয়েছেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাতি হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীদের সাথে তার আচরণ সম্পর্কে আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তরে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাস্যোজ্জল চেহারা সম্পন্ন, অমায়িক চরিত্রের অধিকারী ও বিনয়ী ছিলেন।
কঠোর ছিলেন না। তাঁর নিকট আগত ব্যক্তি নিরাশ ও হতাশ হতো না। তিনি নিজের মধ্য হতে তিনটি জিনিস পরিত্যাগ করেছিলেন এক. রিয়া বা আত্মপ্রকাশ। দুই. অতিরঞ্জন। তিন. অনর্থক কার্যকলাপ। আর মানুষের জন্য তিনি তিনটি জিনিসকে পরিত্যাগ করেন। এক. তিনি কাউকে নিন্দা করতেন না। দুই. কাউকে দোষারোপ করতেন না।
তিন. সওয়াবের প্রত্যাশা ব্যতীত কোন কথাই বলতেন না। যখন তিনি কথা বলতেন, শ্রবণকারীরা এমনভাবে কান পেতে শুনত যেন তাদের মাথায় পাখি বসে আছে। অতঃপর যখন তিনি কথা শেষ করতেন তখন তারা কথা বলতো।
তারা তার সামনে কখনো ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি করত না। তার নিকট কেউ কথা বলা আরম্ভ করলে তারা তার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকত। তার উপস্থিতিতে তাদেরই কথা বলার অধিকার থাকতো যারা প্রথম কথা বলা শুরু করতো। লোকেরা যাতে হাসে তিনিও তাতে হাসতেন। মানুষ যাতে আশ্চর্য হয় তিনিও তাতে আশ্চর্য হতেন এবং বলতেন যখন তোমরা কোন অভাবীকে তার প্রয়োজনীয় কিছু প্রার্থনা করতে দেখো তার প্রার্থনায় তাকে সাহায্য করো। তিনি মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা পছন্দ করতেন না।
কারো কথা বলার সময় তার কথার মাঝে বাধা দিতেন না। হ্যাঁ, তবে সীমা অতিক্রম করলে তাকে হয়তো আদেশ বা নিষেধ করতেন। (তিরমিযী শরীফ) তিনি মানবজাতিকে বলে গেছেন, প্রকৃত মুসলিম তো সে ব্যক্তি যার হাত ও কথার অনিষ্ট হতে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে। আর প্রকৃত মুহাজির তো সে ব্যক্তি যে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নিষেধকৃত বস্তুকে ছেড়ে দেয়। (সহিহ বুখারী : হাদিস ১০) তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জান, মাল ও কথার দ্বারা যুদ্ধ করো। (সুনানে আবু দাউদ)
আমি অভিসম্পাতকারী রূপে প্রেরিত হয়নি। বরং আমি দয়ালু রূপে প্রেরিত হয়েছি। (সহিহ মুসলিম: হাদিস ২৫৯৯) যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে মৃত্যুবরণ করল সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে (সহি বুখারী: হাদিস ৪৪৫৭)।
আজকে যদি আমাদের সমাজে অন্যায় অবিচার ও জুলুম নিপীড়ন দূর করতে হয় তাহলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে নববী আদর্শের দিকে। ফিরিয়ে আনতে হবে সাহাবায়ে কেরামের সেই সোনালী যুগ।
যে যুগে রাজা-প্রজার তফাৎ উঠিয়ে দিয়ে ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। তাই আসুন, আমরা আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নববী-আদর্শের অনুসরণ করি। তাহলে আমরা আমাদের সফলতা খুজে পাব এবং এর মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তির ফয়সালা হবে।
দুনিয়ার জীবন তো ক্ষণস্থায়ী এখানে আমরা চিরদিন থাকবো না। একদিন আমাকে চলে যেতেই হবে। কেউ হয়তো চলে যাবে খালি হাতে। কেউ সফলতার ঝুড়ি হাতে নিয়ে। তাই পরকালীন জীবনকে সুন্দর করার জন্য আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথ এবং পদ্ধতিতেই চলতে হবে। তা ভিন্ন অন্য কোন পথে চলার মাধ্যমে আমরা সফল হতে পারব না এবং পরকালেও মুক্তি পেতে পারবোনা।
আমরা যদি পরকালের মুক্তি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশের আশাবাদী হই তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে কোরআন এবং হাদিস গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে এবং পরিপূর্ণ ইসলামকে মানতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথেই আমাদেরকে চলতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করেন। আমীন।
শিক্ষক: মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস তেজগাঁও ঢাকা
-এটি