মুফতি আহমাদ রাফি জাকির।।
মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এই দুনিয়ায় আসবেন, তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন হযরত মুহাম্মাদ আল-আরাবি সা.। তিনি জ্বিন-ইনসান উভয় জাতিরই নবি। এবং তিনি সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের ইমাম-সায়্যিদুল মুরসালিন।
বিচার দিবসে সায়্যিদুল বাশার হযরত মুহাম্মদ সা. মর্যাদাকে মহান আল্লাহ তা'আলা সমুন্নত করে দিবেন। আমাদের উপর মহান প্রভু বিরাট এহসান করে সেই মহান ব্যক্তির উম্মাহ বানিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু যুগে যুগে কাফির-মুশরীক-নাস্তিক-মুরতাদ এবং তাদের দালালরা বিশ্ব নবি সা. মান-সম্মান-শ্রেষ্ঠত্বে কালি লেপনে প্রতিনিয়ত গালি-গালাজ-বিদ্রুপ- অবমাননা করে আসছে। যাতে মুসলিম উম্মাহ'র হ্রদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
মুসলমানদের প্রাণের চেয়ে বেশি প্রিয় পেয়ারা নবি, হযরত মুহাম্মাদ সা. কে নিয়ে কেউ ঠাট্টা বিদ্রুপ-মশকারা করবে আর প্রকৃত মুসলমানরা জেগে উঠবে না তা হতেই পারেনা।
নবিজি সা. রেখে যাওয়া আদর্শ এবং তাঁর ইজ্জত-সম্মানকে স্বস্হানে বহাল রেখে বেচেঁ থাকাই হলো মুসলমানদের ঈমানি দ্বায়িত্ব। আর কুরআনুল কারিম-হাদিস নববিতে প্রিয় নবিজিকে কটাক্ষকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান বর্ণিত আছে।
কুরআন-সুন্নাহ'র আলোকে শাতিমে রাসুলের শাস্তির বিধান।
কুরআনুল কারীমের সুরা আহযাবের ৫৭ নং আয়াতে এসেছে. "যারা আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসুল সা. কে কষ্ট দেয় আল্লাহ তা'আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তাদেরকে অভিশপ্ত বানিয়েছেন, এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্চনাকর শাস্তি"। [সুরা আহযাব, আয়াত নং ৫৭]
যারা আল্লাহ তা'আলা এবং রাসুল সা.কে কষ্ট দেয় এই আয়াত অনুযায়ি তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব।
সহিহুল বুখারীতে ইহুদি গোত্রনেতা কা'ব ইবনে আশরাফের কথা বর্ণিত আছে, একদা নবি করিম সা. বললেন, কে আছো কা'ব ইবনে আশরাফের (হত্যা) জন্য, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়। তখন হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা রা. দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কি চান আমি তাকে হত্যার দায়িত্ব নেই?
তিনি বললেন, হ্যাঁ'। তখন সাহাবি বললেন, তাহলে আমাকে কিছু কৌশলি কথা বলার অনুমতি দিন, নবিজি সা. তাঁকে অনুমতি দিলেন। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা. নবিজি সা. নিকট এসে বললেন, এই লোকটা (মুহাম্মাদ সা.) তো এখন আমাদের নিকট সাদকা চাচ্ছে। লোকটা আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কা'ব এ কথা শুলে বললো, তোমরা তাঁর ব্যাপারে আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
(এভাবে কৌশলি আলোচনায় কা'বের নিকট ঘনিষ্ঠ হয়ে যান) পরে তিনি কা'ব ইবনে আশরাফকে হত্যা করেন। [সহিহুল বুখারি পৃ.৫৭৬ খণ্ড.২ মাক.ইস.]
হাদিসটি বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, কা'ব ইবনে আশরাফ নবিজি সা. এর নিন্দা করত। ফলে নবিজি সা. তাকে হত্যা করার আহ্বান জানান, কা'বের জনবল নবিজি সা.নিকট এসে বলল, আমাদের সরদার কা'ব ইবনে আশরাফকে গুপ্তচরে হত্যা করা হয়েছে। নবিজি সা. বললেন, অন্যদের মতো সেও যদি সংযত থাকত তাহলে এমন ক্ষতির মুখোমুখি হতো না। আমরা তার থেকে কষ্ট পেয়েছি।
সে আমাদের নিন্দা করে কাব্য রচনা করেছে। তোমাদের কেউ যদি এমন জঘণ্য কর্মে লিপ্ত হয় তাহলে তরবারিই তার আসল ফায়সালা করবে।[ আস-সারিমুল মাসলুল আলা শাতিমির রাসুল পৃ.৪৬ মাক.নুসুস]
সুতরাং যে কেউ রাসুল সা. কে নিয়ে কটুক্তি করবে তাকেই হত্যা করা হবে-সে "ওয়াজিবুল কতল"। এ ক্ষেত্রে চার মাযহাবের ইমামদের মতামত:
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. তাঁর "আস-সারিমুল মাসলুল আলা- শাতিমির রাসুল'গ্রন্হে উল্ল্যেখ করেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেন, শাতিমে রাসুলকে হত্যা করা হবে। চাই সে মুসলিম হোক বা কাফের।
তিনি আরও বলেন, যে রাসুল সা.কে গালমন্দ করে, রাসুলের শানে গোস্তাকি করে তাকে তাওবারও সুযোগ দেওয়া হবে না। আমাদের [হাম্বলি মাজহাবের] পূর্ববর্তী ফকিহগণ এবং অনুসারীদের সিদ্ধান্ত হলো- এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. বর্ণিত সুস্পষ্ট মতকে আপন স্হানে স্ব-স্ব অবস্হায় রাখতে হবে। অথ্যাৎ শাতিমে রাসুলকে হত্যা করতে হবে এবং যিম্মি হলে তার নিরাপত্তা বাতিল করতে হবে।
[আস-সারিমুল মাসলুল আল-শাতিমির রাসুল পৃ.১৩]
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস আশ-শাফি রাহিমাহুল্লাহ'র বলেন, শাতিমে রাসুলকে এমন গর্হিত কাজের দরুণ সে যিম্মি হলে তার নিরাপত্তা বাতিল করে তাকে হত্যা করা অপরিহার্য।
হানাফি মাযহাবের ভাষ্য মতে কটূক্তি করার কারণে যিম্মির নিরাপত্তা বাতিল হবে না এবং তাকে হত্যা করা ও হবে না।
তবে এমন জগণ্য অন্যায়ের দরুণ তাকে "তাযির" হিসাবে তাকে শাস্তিলাভ দেওয়া হবে।[ "তাযির" কখনো মৃত্যুদণ্ড হতে পারে] কেননা হানাফি মাযহাবের মূলনীতি হলো- যেসব অপরাধে হত্যার বিধান নেই- সেসব অপরাধ যদি বারংবার হয় তাহলে ইমাম-রাষ্ট্রপ্রধান অপরাধিকে হত্যা করতে পারবে।
আর ইমাম চাইলে অপরাধিকে নির্ধারিত হদ বা শাস্তির চেয়ে অধিক শাস্তি দিতে পারেন। হানাফি ফকিহগণ মৃত্যুদণ্ড ছাড়া যেসব অপরাধে রাসুল সা.বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে হত্যার রেওয়ায়াত আছে, সে সমস্ত বিধানে মৃত্যুদণ্ড কে কল্যাণকর মনে করে হত্যা করা হয়েছে বলে সাব্যস্ত করেন। এ হত্যাকে"কতল বিস-সিয়াসত" বা ‘রাজনৈতিক কল্যাণ’ হিসাবে অবহিত করেন। অধিকাংশ হানাফি ফকিহদের মতে বারংবার এমন অপরাধ করার ফলে "গোস্তাকে রাসুল" কে হত্যা করার অধিকার মুসলিম শাসকের রয়েছে। রদ্দুল মুহতার আল আদ-দুররিল মুখতার পৃ.৩৪৫ খণ্ড.৬ মাক.দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ। আস-সারিমুল মাসলুল আল-শাতিমির রাসুল পৃ.১৫ মাক.নুসুস]
ইমাম মালিক রাহ. মাযহাব হলো: শাতিমে রাসুল, রাসুল সা. গালিদাতা বা কটুক্তিকারির একমাত্র শাস্তি কেবলই হত্যা, অন্যকিছু নয়।[ আস-সারিমুল মাসলুল..পৃ.৮৪ ]
কিয়াসের আলোকে রাসুল সা.'র কটূক্তিকারীকে হত্যা করতে করা আবশ্যক। শাতিমে রাসুলকে বন্দি করে রাখা বা বিনিময় নিয়ে ছেড়ে দেওয়া অথবা দয়া করে মুক্তি দেওয়া এসবই নাজায়েয। কটূক্তি কারী যদি মুসলিম ব্যক্তি হয়, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে হত্যা করতে হবে। কারণ সে হয়তো"মুরতাদ" নয়তো "যিনদিক"।
আর মুরতাদ ও যিনদিককে তো হত্যা করতেই হয়, তাদের জন্য অন্য হুকুম নাই। কটূক্তিকারী কাফির তাকেও হত্যা করতে হবে। আর রাসুল সা.কে কটূক্তিকারী নারী-পুরুষের শাস্তির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এটিই সালাফদের অধিকাংশ ফকিহ ও তাদের অনুসারীদের অভিমত। [আস-সারিমুল মাসলুল আলা-শাতিমির রাসুল পৃ.৮২ মাক.নুসুস]
-এটি