মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ।।
জীবন বাস্তবতার অন্যতম অনুষঙ্গ চাকরি। কর্মক্ষেত্রে কখনো ওই সোনার হরিণই বাঘের খাঁচায় আটকে পড়ে। কর্মকর্তা, কর্মচারী যে যে অবস্থানেই থাকি না কেন, চাকরিও হতে পারে আমাদের ইহ-পরকালীন উত্থান-পতনের বাহন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘...তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলে যেয়ো না।
’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)
জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সূক্ষ্ম-সুচারু ব্যবহারের অভিজ্ঞতা মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এতেই মানুষের নব নব আবেগ-অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং পরিশ্রম, সাধনা ও কর্মেই মানুষের পরিণতি ঠিক হয় :
‘কর্মেই গড়ে মানুষের জীবনসত্তা
কর্মেই বণ্টিত হয়—জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালা। ’
(আল্লামা ইকবাল)
চাকরিজীবীর যোগ্যতা : চাকরিজীবীর অন্যতম যোগ্যতা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে—
‘ভালো সে কর্মচারী হবে নিশ্চয়
যে শক্তিশালী ও বিশ্বাসী রয়। ’
(কাব্যানুবাদ, সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৬)
এখানে ‘শক্তি ও বিশ্বস্ততা’কে চাকরিজীবী কর্মকর্তা বা কর্মচারী সবার জন্যই প্রধান যোগ্যতা হিসেবে স্থির করা হয়েছে। অন্যদিকে ‘জীবনের জন্য জীবিকার্জন’ একটি ইবাদততুল্য কর্তব্য।
পেশাগত সম্মান ও হালাল-হারাম : চাকরি একজন সুনাগরিকের উপার্জনের মাধ্যম, পেশাগত পরিচয়। মহান আল্লাহ সবার ‘রিজিকদাতা’, মানুষের জন্য ব্যবস্থা করেছেন ‘রিজকান কারিমা’ (সম্মানজনক জীবিকা) এবং এর অর্জন কৌশল হতে হবে ‘হালালান তাইয়্যেবা’ (বৈধ ও পবিত্র)।
ইসলামের দৃষ্টিতে চাকরি নির্বাচনেও আছে বৈধ-অবৈধতার প্রান্তসীমা। মহান আল্লাহর আদেশ ও প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ বিবর্জিত উপায়ের সব চাকরি ও চাকরির আয়-রোজগার হারাম। যেমন—সুদ ও মাদক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি।
চাকরিজীবীর করণীয়-বর্জনীয় :
ক. নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষের আরোপিত শর্ত মেনে চলা। চাকরিও অঙ্গীকার। মহান আল্লাহ বলেন ‘...তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূরণ করো। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১)
খ. কর্তৃপক্ষের আনুগত্য, বৈধ আদেশ-নিষেধ পালন করা।
গ. কর্তব্যে অবহেলা পরিহার।
ঘ. কর্তৃপক্ষের সম্পদ, স্বার্থ রক্ষা করা।
ঙ. অফিসের গাড়ি, অধীন কর্মচারী ও অফিস সামগ্রীর ব্যক্তিগত ব্যবহার পরিহার।
চ. দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার পরিহার।
নবী-রাসুলদের কর্মমুখিতা : পরমুখাপেক্ষী ও ভোগবাদী নয়, বরং শ্রমই ছিল নবী-রাসুলদের আদর্শ। তাঁদের কর্মময় জীবনের বিবরণে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, আল্লাহ কোনো নবী পাঠাননি, যিনি ছাগল চড়াননি। জিজ্ঞাসা করা হলো—আপনিও কি তাদের মতো? তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমিও কয়েক কিরাতের (দিরহাম) বিনিময়ে মক্কাবাসীর ছাগল চড়াতাম। (বুখারি)
প্রিয় নবী (সা.) বিবি খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসা পরিচালনা করেছেন এবং যুদ্ধের ময়দানে পরিখা খননের সময় তাঁর মোবারক হাতে মাটি কেটেছেন। তিনি (সা.) বলতেন, ‘আল কাসিবু হাবিবুল্লাহ’ অর্থাৎ শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু।
কর্মতৎপরতাই সাফল্যের চাবিকাঠি : অপদার্থের মতো অলস জীবনযাপন ইসলামের শিক্ষা নয়। আবু দাউদ শরিফের একটি দীর্ঘ হাদিসে জানা যায়, প্রিয় নবী (সা.) ভিক্ষুকের হাতকে শ্রমিকের হাতে রূপান্তর করেছিলেন।
চাকরিজীবীর অধিকার সংরক্ষণ : দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সব কর্মতৎপরতা ও কর্মীর স্বার্থ সংরক্ষণে ইসলাম অত্যন্ত সোচ্চার। কর্মকর্তা-কর্মচারীর শ্রম-ঘাম মানুষের জীবন চলার গতিকে করে স্বচ্ছন্দ, তাই তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ একটি আমানত। প্রিয় নবী (সা.)-এর হুঁশিয়ারি—কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনবেন। তার মধ্যে একজন ওই ব্যক্তি, যে অধীনকে পরিশ্রম করিয়ে পূর্ণ কাজ আদায় করেও তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করেনি। (বুখারি)
প্রিয় নবী (সা.)-এর বিখ্যাত উক্তি—‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। ’ (বায়হাকি)
পেশাগত অসদাচরণের প্রতিকার : ইসলামের দৃষ্টিতে চাকরিজীবীকে অযৌক্তিক চাপে হয়রানির সুযোগ নেই। পেশাগত অসদাচরণের প্রতিকার, প্রতিবিধানে ইসলামের নীতি প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা—‘[নবী সুলাইমান (আ.)] বলেন, কী হলো, হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা হত্যা করব অথবা সে উপস্থাপন করবে যুক্তিসংগত কারণ...। ’ (সুরা : নামল, আয়াত : ২০, ২১)
আয়াতে চাকরিজীবীর দায়িত্বে অবহেলা, অপরাধের ক্ষেত্রে চাকরিবিধির গুরুতর তিনটি দিক খুঁজে পাওয়া যায়—
ক. অভিযোগ থাকলে—কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া।
খ. দোষী প্রমাণিত হলে—শাস্তি দেওয়া।
গ. অপরাধ গুরুতর হলে—চাকরি থেকে বরখাস্ত করা।
কাজেই চাকরিজীবী কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার মেধা ও যোগ্যতা কল্যাণকর ব্যবহারের মাধ্যমে জাতি গঠনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করা আমাদের ঈমানি কর্তব্য।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর।
সূত্র: ইসলামী জীবন।
এনটি