খালিদ সাইফুল্লাহ: এবার হজযাত্রা নিয়ে মহাসঙ্কট দেখা দিয়েছে। সৌদি অংশের খরচের হিসাব পাওয়ার আগেই প্যাকেজ ঘোষণা করে বিপাকে পড়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সরকারি ও বেসরকারি এজেন্সিদের ঘোষিত প্যাকেজেই যেখানে এক থেকে দুই লাখ টাকা খরচ বেড়েছে সেখানে সৌদি অংশের খরচ জানার পর এ খাতে আরো এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার এক জরুরি বৈঠক ডেকেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
এদিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেও এবার হজ কার্যক্রমে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ জন্য বেসরকারি এজেন্সি মালিকদের মধ্যে চাপা উদ্বেগ বিরাজ করছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে এক লাখ ৩৭ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পবিত্র হজ পালনের নির্ধারিত কোটা রয়েছে। তবে মহামারী করোনার কারণে গত দুই বছর বাংলাদেশ থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এ বছর কোটার ৪৫ ভাগ অর্থাৎ ৫৭ হাজার ৫৮৫ জন হজ পালন করতে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে চার হাজার যাবেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যাবেন ৫৩ হাজার ৫৮৫ জন। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এ বছর যারা হজে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ২০১৯ সালে প্রাক-নিবন্ধন এবং ২০২০ সালের নিবন্ধন করে রাখেন। প্রাক-নিবন্ধনের জন্য ৩০ হাজার ৭৫২ টাকা পরিশোধ করেন তারা। এরপর ২০২০ সালে চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময় আরো এক লাখ ৫১ হাজার ৯৯০ টাকা পরিশোধ করেন।
ওই বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের তিনটি প্যাকেজ ছিল। প্যাকেজ-১ এ চার লাখ ২৫ হাজার, প্যাকেজ-২ এ তিন লাখ ৬০ হাজার এবং প্যাকেজ-৩ এ তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা। এ বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় দু’টি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্যাকেজ-১ এ পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা এবং প্যাকেজ-২ এ চার লাখ ৬২ হাজার ১৫০ টাকা, যা ২০২০ সালের তুলনায় এক লাখ টাকারও বেশি। ক্ষেত্রবিশেষে দেড় থেকে দুই লাখ ১২ হাজার টাকা বেশিও লাগছে। এর সাথে পশু কুরবানি বাবদ আরো ১৯ হাজার ৬৮৩ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য হাব ২০২০ সালে দু’টি বেসরকারি প্যাকেজ ঘোষণা করে। এতে কুরবানি ছাড়া সাধারণ প্যাকেজে খরচ ধরা হয় তিন লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা। আর ইকোনমি প্যাকেজের খরচ ধরা হয় তিন লাখ ১৭ হাজার টাকা। এ বছর একটি সাধারণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে খরচ ধরা হয়েছে চার লাখ ৬৩ হাজার ৭৪৪ টাকা।
জানা যায়, সৌদি অংশের খরচ না পেয়ে আগের খরচের সাথে মিলিয়ে একটি খরচ ধরে প্যাকেজ ঘোষণা করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। আর তাতেই লাখ টাকা খরচ বেশি ধরা হয়। এ প্যাকেজে সৌদি মোয়াল্লেমের অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ ধরা হয় দুই হাজার ৫২০ রিয়াল যা বাংলাদেশী টাকায় ২৪ টাকা ৩০ পয়সা বিনিময় হারে ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ ও পরিবহন ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৭৫৪ দশমিক ৫৫ রিয়াল; যা বাংলাদেশী টাকায় ৪২ হাজার ৬৩৫ টাকা। ভিসা ফি ধরা হয় ৩৪৫ সৌদি রিয়াল বা আট হাজার ৩৮৩ টাকা এবং ইন্স্যুরেন্স ফি ধরা হয় ১১০ সৌদি রিয়াল বা দুই হাজার ৬৭৩ টাকা।
তবে গত ২৪ মে মক্কায় অবস্থিত বাংলাদেশ হজ অফিসের কাউন্সেলর (হজ) মো: জহিরুল ইসলাম ধর্ম মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠান। এতে তিনি জানান, বাংলাদেশের হজ প্যাকেজে সৌদিতে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ দুই হাজার ৫২০ রিয়াল ধরা হলেও সেখানে হাজীদের জামারা থেকে বিভিন্ন দূরত্বে রাখার শর্তে যে এ, বি, সি ও ডি ক্যাটাগরি ঠিক করা হয় তার মধ্যে সৌদি সরকার সি ও ডি ক্যাটাগরির খরচের হিসাব জানিয়েছে। এতে দেখা যায়, প্যাকেজ সি এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৮০৬ রিয়াল; যা বাংলাদেশী টাকায় এক লাখ ৬৫ হাজার ৩৮৫ টাকা এবং প্যাকেজ ডি তে ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৫৬ দশমিক ৮৭ রিয়াল; যা বাংলাদেশী টাকায় এক লাখ ৩৭ হাজার ৪৬১ টাকা। তবে প্যাকেজ-১ ও প্যাকেজ-২ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। নিশ্চিতভাবে তার খরচ সি ও ডি প্যাকেজের তুলনায় আরো বেশি হবে। ফলে বাংলাদেশ থেকে জনপ্রতি সি প্যাকেজের জন্য বর্তমান প্যাকেজ থেকে আরো এক লাখ চার হাজার ১৫০ টাকা এবং ডি প্যাকেজের জন্য ৭৬ হাজার ২২৬ টাকা বেশি হবে। তবে পরিবহন খরচে সৌদিতে এক হাজার ৪২৪ রিয়াল ধরা হয়েছে।
এতে সাশ্রয় হবে ১৩০ রিয়াল বা তিন হাজার ১৬৪ টাকা। ভিসা ফি ধরা হয়েছে ৩০০ রিয়াল। ফলে সাশ্রয় হবে ৪৫ রিয়াল বা এক হাজার ৯৪ টাকা। ফলে মোট খরচ বাড়বে সি প্যাকেজের জন্য ৯৯ হাজার ৮৯২ টাকা এবং ডি প্যাকেজের জন্য ৭১ হাজার ৯৬৮ টাকা। অবশ্য হজ এজেন্সিগুলো এখনো সৌদি বাড়ি ভাড়া করতে পারেনি। এবার সৌদিতে বাড়ি ভাড়াও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিকরা। সেক্ষেত্রে খরচ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
এ ব্যাপারে গতকাল বুধবার ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মো: ফরিদুল হক খান নয়া দিগন্তকে বলেন, সৌদি আরব বিভিন্ন উন্নয়নের কথা জানিয়ে খরচ অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের হজযাত্রীদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা আজ একটি জরুরি বৈঠকে বসছি। আশা করছি একটি সমাধানে আসতে পারব। বিষয়টি কিছুটা জটিল হয়ে গেল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে সঙ্কট বাড়তে পারে : শুধু খরচ বৃদ্ধিই নয় এবার মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেও হজে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এ বছর যারা হজে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ২০১৯ সালে প্রাক-নিবন্ধন এবং ২০২০ সালের নিবন্ধন করে রাখেন। প্রাক-নিবন্ধনের জন্য ৩০ হাজার ৭৫২ টাকা পরিশোধ করেন তারা। এরপর ২০২০ সালে চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময় আরো এক লাখ ৫১ হাজার ৯৯০ টাকা পরিশোধ করেন। ওই সময় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজে তিন লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা। এবং ‘ইকোনমি’ প্যাকেজের খরচ ধরা হয় তিন লাখ ১৭ হাজার টাকা। অনেক হজযাত্রী ওই সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে নিবন্ধনের টাকার পাশাপাশি বাকি এক লাখ ৩৪ হাজার বা এক লাখ ৭৯ হাজার টাকা বা কমবেশি প্রদান করেন। এ টাকার মধ্যে কোনো কোনো মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্সিকে কিছু টাকা দিলেও অনেক মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্সিকে কোনো টাকা দেননি। করোনার দুই বছরে মধ্যস্বত্বভোগীরা ওই টাকা নিজেদের কাজে ব্যয় করে ফেলেছেন।
এখন নিবন্ধনের সময় অনেক হজযাত্রীর কাছ থেকে নেয়া ২০-৩০ লাখ টাকা তাদের একসাথে পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু তারা এ টাকা দিতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন। এ কারণে অনেকে এখন হজযাত্রীদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিবন্ধন শেষ হয়ে গেলেও এজেন্সি মালিকরা এখনো অনেক হজযাত্রীর কাছ থেকে টাকা পাননি বলে বেশ কিছু এজেন্সি মালিক জানিয়েছেন। ফলে হজযাত্রীদের এসব টাকা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে এজেন্সি মালিক না পেলে তাদের হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। মধ্যস্বত্বভোগীদের কেউ কেউ পালিয়েও যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।