সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


সিয়ামের গুরুত্ব ও প্রতিদান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ।।

মানবজীবনে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। রোজা—মহান রবের ফরজ বিধান। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম রোকন। অনন্য ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি ইবাদত।
যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের ঈমানি চেতনা সুদৃঢ় হয়। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন হয়। অত্যন্ত গভীরভাবে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সঞ্চারিত হয়।

রোজা; এটির আরবি শব্দ সওম, যার আভিধানিক অর্থ—বিরত থাকা। পরিভাষায় সওম বলা হয়—প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোযাভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। এ মাহে রমজানের রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ করা হয় হিজরির দ্বিতীয় শতাব্দীর রমজান মাসে। ইতিপূর্বে এ রোজা অন্যান্য জাতির ওপরও ফরজ ছিল। কেননা তা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের অন্যতম একটি । এটিকে আল্লাহ তায়ালা অন্যান্য বহু আদেশ-নির্দেশের মতোই ফরজ করেছেন।সুতরাং রমযান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর পূর্ণ রমযান রোযা রাখা ফরয। রোজার হুকুম সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে বর্ণিত হচ্ছে—আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ; যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

আবার দয়াময় আল্লাহ তাআলা কেবলমাত্র মাহে রমজানের রোজা রমজান মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেননি, বরং শরিয়তসম্মত কোনো অনিবার্য কারণবশত কেউ রমজান মাসে রোজা পালন করতে না পারলে এরপর অন্য যেকোনো সময় সে রোজার কাজা আদায় করবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে—সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের।তারপরও তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হয় অথবা সফরে থাকে তাহলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। যাদের জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক হয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া-একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা তা জানতে। (সূরা বাকারাহ-১৮৪)

পরবর্তী আয়াতে আরো বলেন— তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না, এ জন্য যে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎ পথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা কীর্তন করবে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

কাঙ্ক্ষিত রোজা মুসলমানদের নিয়মতান্ত্রিক পানাহার, চলাফেরা ও ঘুমসহ আধ্যাত্মিক জীবনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে। মুমিন বান্দাগণ রোজার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ করেন। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের জন্য এটি একটি বাৎসরিক নেয়ামত, যার মাধ্যমে রোজাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। রোজাদারের মন পুলকিত হয়। তাইতো বলা হয়—আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের এক বড় সুযোগ এই রোজা। আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমত ও নিয়ামতের অফুরন্ত ভান্ডারের দরজা রোজাদারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

রোজার প্রতিদান সম্পর্কে হাদীসসমূহ :-

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও পর্যালোচনাসহ রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুণাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী: ৩৮, সহীহ মুসলিম: ৭৬০)

রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, সিয়াম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য। কিন্তু সিয়াম আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। সিয়াম বন্দার জন্য ঢালস্বরূপ।— অবশ্যই সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের গন্ধের থেকেও সুগন্ধি। সিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশি, যখন যে ইফতার করে এবং যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। (সহীহ বুখারী: ১৯০৪)

হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বনি আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি হতে থাকে, ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত, এমনকি আল্লাহ চাইলে তার চেয়েও বেশি দেন। (সহিহ মুসলিম হাদিস : ১১৫১)

হযরত সাহল বিন সা’দ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, জান্নাতের একটি দরজা আছে, একে রাইয়ান বলা হয়। এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন একমাত্র সিয়াম পালনকারী ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাঁদের ছাড়া অন্য কেউ এই পথে প্রবেশ করবে না। সেদিন এই বলে আহ্বান করা হবে- সিয়াম পালনকারীগণ কোথায়...? তাঁরা যেন এই পথে প্রবেশ করে। এভাবে সকল সিয়াম পালনকারী ভেতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অত:পর এ পথে আর কেউ প্রবেশ করেবে না। (সহীহ বুখারী: ১৮৯৬, সহীহ মুসলিম: ১১৫২)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রোজা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তাঁর ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাঁকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন দুজনের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে।' ( মুসনাদে আহমদ হাদিস : ৬৫৮৯)

উপরোক্ত কয়েকটি হাদীসের আলোকে পরিলক্ষিত হয়— রোজার প্রতিদান ঈর্ষণীয়। রোজার গুরুত্ব সীমাহীন। এমনিভাবে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আরো বিভিন্ন জায়গাতে রোজা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।

পরিশেষে—দীর্ঘ একটি বছর পর পবিত্র মাহে রমজানের রোজা মুমিনের দরজায় কড়া নাড়ে।মুমিন একটি মাস রোজা পালন করে, অতঃপর আবার রমজানের রোজা বিদায় নেই। এভাবেই বছর যুগ শতাব্দী ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে। যুগান্তরের ঘূর্ণনে আমাদের বয়স বেড়েই চলছে। শুধু হারিয়ে ফেলছি—একটি বছরের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। ফজিলত ও বরকতপূর্ণ একটি ইবাদত। কদিন পরেই হয়তো জীবনের তরে এ নেয়ামত হারিয়ে যাবে। নেয়ামত থাকবে ; তবে আমি হারিয়ে যাব। অতএব এই মাসকে গুরুত্ব দেওয়া আমাদের জন্য আবশ্যক। রোজার প্রতি যত্নবান হওয়া কর্তব্য। আল্লাহ আমাদেরকে রোজার গুরুত্ব বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: কবি,গীতিকার ও প্রাবন্ধিক

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ