সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


রোজার গুরুত্ব ও উপকারিতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।আবদুল কাইয়ুম শেখ।।

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বহু হাদিসে রোজার ফজিলত, গুরুত্ব, মর্যাদা, উপকারিতা ও লাভের কথা বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। রোজার ফজিলত ও উপকারিতা-সমৃদ্ধ রেওয়ায়েতগুলো জানার মাধ্যমে মুসলমানগণ রোজা পালনে উৎসাহিত হয়। এমনকি প্রকৃত বিশ্বাসী মুমিনের জন্য রোজা বর্জন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়! তাই বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা রমজানের রোজার ফজিলত, গুরুত্ব, লাভ ও উপকারিতা সম্পর্কে প্রামাণ্যভাবে আলোকপাত করব!

কোনো ব্যক্তির দান তার ক্ষমতা অনুযায়ী হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দান তাদের মর্যাদা অনুযায়ী হয়। একজন মন্ত্রী বা এমপির দান তার সামর্থ্য অনুযায়ী হয়। অনুরূপভাবে একজন চেয়ারম্যান, মেম্বার বা সরকারি চাকরিজীবীর দান তার সক্ষমতা অনুযায়ী হয়। আর সাধারণ মানুষের দান তার মতোই সাধারণ হয়। রোজা হলো এমন এক অনন্য ইবাদত যার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রদান করবেন।

যার কোনো অভাব নেই! যার বিত্ত-বিভব ও ধনৈশ্বর্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই! যার ধন-ভাণ্ডার অফুরন্ত ও ক্ষয় লয়হীন! এই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধীশ্বর, নিখিল বিশ্বের অধিপতি মহাস্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যখন রোযার প্রতিদান নিজ হাতে প্রদান করবেন তখন কত বিপুল পরিমাণে দেবেন তা ভাবলেই তনুমনে আনন্দের শিহরণ জাগে!

রোজার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা প্রদান করবেন মর্মে হাদিস শরিফে এসেছে : হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'আল্লাহ তাআলা বলেছেন, রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব!' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)

রোজার বিনিময়ে জান্নাত : জান্নাত এমন এক স্থান যেখানে কেবল সুখ আর সুখ! শান্তি আর শান্তি! উল্লাস, ফুর্তি, আনন্দ-বিনোদন ও খুশির মওজ সব সময় সেখানে চলমান। দুঃখ-দুর্দশা, বালা-মুসিবত ও কষ্ট-ক্লেশের নামমাত্র সেখানে নেই। আমরা পৃথিবীতে একটি বাসা, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হলে অত্যন্ত আনন্দিত হই। অথচ এই নিবাস ক্ষণিকের। আর পরকালের আবাস হবে চিরকালের।

রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা চিরকালের বসবাসের জান্নাত দান করবেন। জান্নাতের নেয়ামতরাজির মোহময় বিবরণ দিয়ে হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন : 'আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমন কিছু প্রস্তুত করেছি যা কোনো চোখ কখনো দেখে নি! কোন কর্ণ কখনো শ্রবণ করে নি! এমনকি কোনো অন্তরে এর কল্পনাও উদয় হয় নি!' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৪৪)

শুধু তাই নয়, রোযাদারদের জন্য জান্নাতে একটি স্বতন্ত্র দরজা থাকবে। এই দরজা দিয়ে কেবল রোজাদারগণই প্রবেশ করতে পারবেন। অন্যদের জন্য এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করায় নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, হযরত সাহল রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা রয়েছে, কেয়ামতের দিন এই দরজা দিয়ে কেবল রোজাদারগণই প্রবেশ করবেন। তাদের ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, রোজাদারগণ কোথায়? তখন

রোজাদারগণ দাঁড়াবেন এবং জান্নাতে গিয়ে প্রবেশ করবেন। তাদের ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। যখন তাদের প্রবেশ করা শেষ হবে তখন দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে; ফলে আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না।' (সহিহ বুখারি শরিফ, হাদিস : ১৮৯৬)

রোজাদারের আনন্দ : শত্রুকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত অবস্থায় দেখলে বা তাকে ঘায়েল করতে পারলে প্রত্যেকেই খুশি হয়। আর মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে এমন ভয়ঙ্কর শত্রু যে, আল্লাহর বান্দাদেরকে জাহান্নামে নেওয়ার জন্য মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে তৎপর রয়েছে!

লোকদেরকে নরকে নেওয়ার জন্য প্রাণপণে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে! রোজাদারের জন্য খুশির বিষয় হলো রোজার মাসে এই চিরশত্রু শয়তান ও ক্ষতিকর দুষ্ট জিনদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়।

এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে : হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : রমজান মাসের প্রথম রাতেই শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলা হয়।' (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৪২)

তা ছাড়াও রোযাদারের জন্য রয়েছে স্পেশাল দুটি আনন্দ! সেই দু'টি আনন্দের ব্যাপারে হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রোজা পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে। একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি তার প্রতিপালক আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৯৭)

রোজাদারের জন্য আরো খুশির বিষয় হলো পুণ্য লাভের আশায় রোজা পালন করা হলে তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : 'যে ব্যক্তি ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রমযানের রোজা পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৮)

জাহান্নাম হতে মুক্তিলাভ : রক্তমাংসের মানুষ হয়ে আগুনে প্রজ্জ্বলিত হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! একটি মোমবাতির সামান্য আগুনে নিজের আঙ্গুলকে দশ সেকেন্ড ধরে রাখুন! দেখুন! কেমন অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা সমগ্র দেহ জুড়ে শুরু হয়ে যায়! এটা হলো দুনিয়ার আগুন।

আর জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়ে সত্তরগুণ শক্তিশালী হবে! সে আগুনে পোড়া কত ভয়ংকর ও বিপদজ্জনক হবে তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে! এমন আগুনের জ্বলন হতে দয়াময় আল্লাহ তাআলা রোজার বিনিময়ে মুক্তি দান করবেন।

এ মর্মে হাদিসে এসেছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার জন্য একদিনের রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তাকে এই দিনের বদলে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে নিয়ে যাবেন।' (সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস : ২৬০১)

অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : 'নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রত্যেক দিনে ও রাতে অসংখ্য লোককে (দোজখ হতে) মুক্তি দান করেন।' (মুসনাদে আহমদ)

মুসনাদে আহমদেরই অপর হাদিসে এসেছে, 'রোজা ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি পাওয়ার দুর্গ সদৃশ।' অন্য একটি হাদিসেও রোজাকে জাহান্নাম হতে প্রতিরক্ষার ঢাল বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, 'রোজা ঢাল স্বরূপ!' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)

রোজা অদ্বিতীয় ইবাদত : রোজা এক অনন্য ইবাদত। এর মাধ্যমে নেকির পাল্লা ভারী হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সুরা কারিয়ায় বলা হয়েছে , 'যার (নেকির) পাল্লা ভারী হবে, সে সুখীজীবন যাপন করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে হাবিয়া। আপনি জানেন তা কী? প্রজ্জ্বলিত অগ্নি!'

রোজার মাধ্যমে নেকির পাল্লা ভারি হবে মর্মে হাদিসে এসেছে, হযরত আবু উমামা রা. বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ? তখন তিনি বললেন, 'রোজাকে আঁকড়ে ধরো। কেননা রোজার সমতুল্য কোন আমল নেই!' (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২২২)

আলোচ্য হাদিসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, রোজা রাখার মাধ্যমে প্রভূত পুণ্য অর্জিত হয় ও নেকির পাল্লা ভারী হয়! অন্য কোন আমল করলে এত পরিমাণ পুণ্য পাওয়া যায় না যত পরিমাণ পুণ্য রোজা পালন করার মাধ্যমে পাওয়া যায়। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, হযরত আবু উমামা রা. বলেন, আমি বললাম' হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে কোন একটি আমলের নির্দেশ দিন। তিনি বললেন, 'তুমি রোজাকে আঁকড়ে ধরো। কেননা রোজার কোন বিকল্প নেই। (রোজা একটি অদ্বিতীয় ইবাদত।' (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২২৩)

রোজার সুপারিশ : কেয়ামত এমন এক কঠিন দিন যেদিন কেউ কারো সাহায্য ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে না। সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতা, মাতা, পিতা, পত্নী ও সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে।

এমন এক কঠিন দিনে রোজাদারের মুক্তির জন্য রোজা সুপারিশ করবে। তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। কঠিন মুসিবতের সময় পাশে দাঁড়াবে।

এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : 'রোজা ও কুরআন বান্দার জন্য কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার পালনকর্তা আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও যৌনবাসনা চরিতার্থ করা হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো।

আর কুরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে রাতের বেলা ঘুম হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তখন কুরআন ও রোজার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে!' (মুসনাদে আহমদ)

দুআ কবুল হওয়া : জীবন চলার পথে আমরা অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা ও বালা-মুসিবতের শিকার হই! উপর্যুপরি সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জর্জরিত হয়ে যাই! এসব অবস্থায় আমাদের প্রধান আশ্রয়স্থল হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনিই আমাদেরকে সর্ব প্রকার বিপদ আপদ হতে উদ্ধার করতে পারেন। তাই আমরা সুখে-দুখে ও দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করি।

তিনি সকলের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন না! কিন্তু রোজাদারের প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়। এ মর্মে হাদিসে এসেছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন, 'আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'প্রত্যেক মুসলমানের জন্য রয়েছে (রমজানের) প্রত্যহ দিবারাত্রে গ্রহণযোগ্য দুআ। (অর্থাৎ রোজাদার প্রার্থনা করলে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়।)' (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭৪৫০)

আলোচ্য নিবন্ধের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, রোজা আল্লাহ প্রদত্ত এক অনন্য নেয়ামত ও ইবাদত। এই ইবাদত পালন করার মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ তাআলার হাত থেকে প্রতিদান পাওয়া যায়! জান্নাত লাভ করা যায়! জাহান্নাম হতে মুক্তি পাওয়া যায়। রোজার সুপারিশ লাভ করার সৌভাগ্য অর্জিত হয়।

স্বতন্ত্র এক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ হয়। সঙ্গে সঙ্গে রোজাদারের স্পেশাল দুটি খুশি ছাড়াও রোজা পালনের আরো বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। তাই আসুন! আমরা আল্লাহ প্রদত্ত এই ইবাদতকে যথাযথভাবে পালন করে এর সমূহ কল্যাণ, সুফল ও ফজিলতকে লাভ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি! আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা-১২১২

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ