ফুযায়েল আহমদ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতেন। আপনজনদের খোঁজখবর নিতেন। আপন মেয়েদেরকে দেখতে যেতেন। নাতিদেরকে আনন্দ দিতেন। তাদের সাথে খেলাধুলা করতেন। মেয়ের জামাইদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন।
একদিন তিনি কলিজার টুকরা মেয়ে ফাতেমাকে রাদিআল্লাহু আনহাকে দেখতে এলেন। আলী রাদিআল্লাহু তখন ঘরে ছিলেন না।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিজ্ঞাসার উত্তরে ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা জানালেন: তাদের দুজনের মাঝে একটু মনমালিন্য হয়েছে। তাই আলী রাদিআল্লাহু আনহু ঘর থেকে বের হয়ে গেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু না বলে চলে গেলেন এবং এক লোককে আলী রাদিআল্লাহু আনহুর খোঁজ নিতে বললেন। লোকটি এসে জানালো আলী রাদিআল্লাহু আনহু মসজিদে শুয়ে আছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গিয়ে দেখলেন আলী রাদিআল্লাহু আনহু গণ্ডদেশ মাটিতে রেখে শুয়ে আছেন আর তাঁর গাঁয়ে কিছু ধোলাবালি লেগে আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ওঠো হে আবু তুরাব! তারপর আপন হস্ত মুবারক দ্বারা তার চেহারা থেকে মাটি সরাতে লাগলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহাকে তাঁদের মধ্যকার মনমালিন্যের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেননি আর না জানতে চেয়েছেন যে, তিনি আলী রাদিআল্লাহু আনহুকে কী বলেছেন এবং আলী রাদিআল্লাহু আনহু তাঁকে কী বলেছেন।
এর মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে শেখাতে চেয়েছেন: পরিবার ও দাম্পত্যজীবন একটি পার্সোনাল বিষয়। একটি গোপনীয় জগত। একটি সংরক্ষিত উপত্যকা।
স্বামী-স্ত্রীর ছোট-বড় প্রতিটি বিষয়ে পরিবারের অন্যদের উপস্থিতি, হস্তক্ষেপ ও নাক গলানো সমাধানের পরিবর্তে জটিলতা বৃদ্ধি করে। তিলকে তালে পরিণত করে। মনমালিন্যের হালকা ও স্বাভাবিক আগুনকে নরকে রূপান্তরিত করে।
সুতরাং আল্লাহ যে বিষয়টিকে মাসতূর ও গোপনীয় রেখেছেন সেটিকে প্রকাশ করার এবং উন্মোচন করার চেষ্টা না করা।
বরং স্বামী-স্ত্রীকে আমরা আপন অবস্থায় ছেড়ে দেব। তারা নিজেরা বিবাদ করে আবার নিজেরাই মিলে যাবে। (অবস্থা খুব নাযুক ও বেগতিক হলে ভিন্ন কথা)
সাংসারিক কলহ ও মনমালিন্য সব ঘরে এবং সব পরিবারেই কমবেশি হয়ে থাকে। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। খলিফায়ে রাশেদ আলী রাদিআল্লাহু আনহু এবং নারীদের সরদার ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহার মধ্যেও তো কলহ হয়েছে। মনমালিন্য হয়েছে। রাগ-অভিমান হয়েছে।
তাহলে আমাদের কথা তো বলাই বাহুল্য! সুতরাং আমরা যেন এই বিবাদকে, এই কলহকে, এই রাগ-অভিমান ও মনমালিন্যকে জীবনের একটি অংশ মনে করি এবং এগুলোকে সহজে সমাধান করার এবং এগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও অভিজ্ঞতা লাভ করার চেষ্টা করি।
এগুলোকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক নষ্ট করা, পরিবার ধ্বংস করা এবং সন্তানদেরকে আশ্রয়হীন ও ছিন্নমূল করার মত নিকৃষ্ট ও জঘন্য কাজ কিছুতেই না করি।
আমরা চলুন একটু লক্ষ্য করি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিকমত ও প্রজ্ঞার প্রতি। তিনি নিজে আলী রাদিআল্লাহু আনহুর কাছে গিয়েছেন। আদর করে তাঁকে ডেকেছেন। তার রাগ-অভিমান ভাগানোর চেষ্টা করেছেন।
নিজের মেয়ের সাথে রাগ করায় তাঁকে তিরস্কার করেননি। এমনকি জানতেও চাননি কী ঘেটেছে? কেন ঘটেছে? কেন তিনি ঘরে থেকে বের হয়ে গেছেন?
এটি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের পরিবারের জন্য একটি বিরাট শিক্ষা। এসব পরিস্থিতিতে কোন পরিবারেরই উচিত নয় আপন ছেলে বা মেয়ের পক্ষ নেয়া। বিবাদে জড়িয়ে পড়া। আগুনে ঘি ঢেলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা। বরং স্বামীর পরিবারের কর্তব্য স্ত্রীর ভালোগুলোকে স্মরণ রাখা। তার সুন্দর অতীতগুলোকে সামনে রাখা।
তদ্রুপ স্ত্রীর পরিবারের উচিত স্বামীর উপর চড়াও না হওয়া। তার মেজাজ নষ্ট না করা। তাকে উত্যক্ত ও উত্তপ্ত করে সংসারের ভাঙন ডেকে না আনা।
আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো আলী রাদিআল্লাহু আনহুর আচরণ ও কর্মপন্থা। প্রথমত তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন পারিবারিক সমস্যা, সংকট ও মনমালিন্যের সময় স্বামীর কী করা উচিত?
তিনি স্থান ত্যাগ করেছেন। ঘর থেকে বের হয়ে গেছেন। যেন পরিবেশ শীতল হয়। পরিস্থিতি শান্ত হয়। ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহা যেন স্বাভাবিক হন।
পক্ষান্তরে আমরা রাগের মাথায়, মনমালিন্যের জের ধরে কষ্টদায়ক ও আক্রমণাত্মক বিভিন্ন কথা শুনিয়ে দেই এবং অপর পক্ষ থেকেও বিভিন্ন মন্দ ও অপমানজনক কথার তীরে বিদ্ধ হই।
সঠিক পদ্ধত হলো: এমন পরিস্থিতিতে দূরে সরে যাওয়া এবং পাল্টা আক্রমণ না করে নিরাপদে স্থান ত্যাগ করা।
দ্বিতীয়ত: তিনি নিজে ঘর থেকে বের হয়ে গেছেন। স্ত্রীকে বের করে দেননি। বর্তমানের অনেক স্বামীরাই এমনটি করে থাকে। স্ত্রীকে বের করে দেয়। এটা আসলে চরম বোকামি। কারণ, এতে করে পরিস্থিতি আরো নাযুক ও ঘোলাটে হয়। স্ত্রী ও তার পরিবার এটাকে চরম অপমানজনক মনে করে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
তাছাড়া এতে করে নিজেদের পরিবারের লজ্জা হয় এবং কলঙ্ক ও বদনাম হয়।
যদি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনমালিন্য হয়, বাকবিতন্ডা হয় কিংবা ঝগড়া-বিবাদ হয় তাহলে স্বামী যেন ঘরে থেকে বের হয়ে যায়। তারপর যখন মনে হয় যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে তখন ফিরে আসবে। সেটা ঐদিন রাতেই হতে পারে আবার দুয়েকদিন পরেও হতে পারে।
এতে স্ত্রী অবশ্যই কাবু হবে। শান্ত ও লজ্জিত হবে। স্বামীর চলে যাওয়া তাকে পীড়া দেবে। তবে সাথে সাথে তার মনে এটাও কাজ করবে যে, স্বামী তাকে বাইরে বের করে অপমান করেনি বরং ঘরে নিরাপদে, লোকচক্ষুর আড়ালে সম্মানজনক অবস্থায় রেখে নিজে বের হয়ে গেছে। ফলে তার মনে একটা অনুশোচনা, বিগলিতী ও কৃতজ্ঞতাবোধও সৃষ্টি হবে।
-এটি