আল আমীন ফরীদ
এক.
একজন মুসলমান তাঁর প্রতিটি কাজ চিন্তা-ফিকির ও হিসেবে-নিকেশ করে করবে, কারণসে মুসলমান। তাঁর মনে সর্বদা এ কথা জাগরুক থাকতে হবে যে, আমি দ্বীন হিসেবে যেহেতু ইসলামকে গ্রহণ করেছি, তাই আমার প্রতিটি কাজ হতে হবে ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক।
অন্যান্য ধর্মের মত ইসলাম শুধু উপাসনালয়ে পালনের বিষয় নয়। ইসলাম কিছু আচার-অনুষ্ঠানের নাম নয়
যে, কেউ সপ্তাহে কিংবা বছরে একবার উপাসনালয়ে ঢু মারলো, আর ঈদের দিন নতুন কাপড় পরে ঘুরলো– তাতেই সে মুসলমান হয়ে গেল; ইসলাম তো এমন জীবনব্যবস্থার নাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যার নির্দেশনা বিদ্যমান। আর যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিনিষেধ মানলো না, সে মুসলমান নয়- স্পষ্ট কথা।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে: یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ ٱدۡخُلُوا۟ فِی ٱلسِّلۡمِ كَاۤفَّةࣰ وَلَا تَتَّبِعُوا۟ خُطُوَ ٰتِ ٱلشَّیۡطَـٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوࣱّ مُّبِینࣱ
“হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”১
আয়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনা, মুমিন মাত্রই তাঁকে পরিপূর্ণ- রূপে ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। ইসলামের প্রতিটি বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। একটা মানলাম, অন্যটা মানলাম না, এমন হলে হবে না। আর নিজেকে মুমিন- মুসলমান হিসেবে দাবী করার পরও যদি কেউ ইসলামকে পরিপূর্ণ- রূপে না মানে,তাহলে তার ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে কী ভয়ংকর হুমকি-বাণী:
فَإِن زَلَلۡتُم مِّنۢ بَعۡدِ مَا جَاۤءَتۡكُمُ ٱلۡبَیِّنَـٰتُ فَٱعۡلَمُوۤا۟ أَنَّ ٱللَّهَ عَزِیز حَكِیمٌ
“সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি তোমাদের নিকট আসার পর যদি তোমরা সঠিক পথ থেকে স্খলিত হও, তবে মনে রেখ, আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, মহা প্রজ্ঞাময়।”২
এই হুমকি শোনার পরও কি একজন মুসলমান জেনে- শুনে ইসলামের-প্রতিটি-বিধিনিষেধ না মেনে থাকতে পারে?!
দুই.
আর পরিপূর্ণরূপে যে ইসলামকে মেনে নেয়, বলাবাহুল্য, তার জন্য ইসলামের বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কিংবা অন্যধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, অন্তরে সমর্থন লালন করা কিংবা যবানে একাত্মতা পোষণ করারও সুযোগ নেই।
দলীল হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে পূর্বোক্ত আয়াতের প্রেক্ষাপট: ইহুদীধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে– এমন কিছু সাহাবী রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে অনুমতি চাইলো যে, তারা (ইহুদিধর্মে পালনীয়- দিবস) শনিবার পালন করবে এবং রাতের সালাতে তাওরাত কিতাব পড়বে; তখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে হুকুম দিলেন যে, তোমরা ইসলামের নিদর্শনাবলী প্রতিষ্ঠা করো এবং ইসলাম-বহির্ভূত সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাক।
(হযরত ইকরিমা রহ. এর বর্ণনা মতে) তখন ঐ আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং স্পষ্ট বিধান আসে যে, মুমিন মাত্রই তাঁকে সর্বতোভাবে ইসলামকে মেনে নিতে হবে।ইসলাম-
বিরোধী কোন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া কিংবা তার প্রতি সমর্থন জানানো কোন ভাবে বৈধ নয়।৩
এই একই কথা বর্ণিত হয়েছে সূরা কাফিরূনে; মক্কার কিছু কাফের নেতা যখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে আসল যে,
এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদত করবেন,পরের বছর আমরা আপনার মা'বুদের ইবাদত করব। এই পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয় সূরা কাফিরূন এবং তাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয় যে, ইমান ও কুফর সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। তার মধ্যে এরকম কোন মীমাংসা বা সমঝোতা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়, যা দ্বারা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ঘুচে যাবে এবং সত্য দ্বীনের সাথে কুফর ও শিরকের মিশ্রণ ঘটে যাবে।৪
পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, একজন মুমিনের প্রতি তাঁর ঈমানের অবশ্যপালনীয় দাবী হলো, সে পরিপূর্ণরূপে ইসলামের সমস্ত বিধান মেনে নিবে, ইসলাম-বিরোধী কোন কাজের শরিক কিংবা সমর্থক হবে না, এবং বিধর্মীদের কোন আচার-আচরণ ও কুসংস্কার পালন করবে না।
তিন.
অনৈসলামী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নববর্ষ উদযাপন করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় এবং বরণ করে। বিশেষত, বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতে মঙ্গল-শোভাযাত্রার নামে বিভিন্ন শিরকী কার্যকলাপের মাধ্যমে নববর্ষবরণ করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ণভাবে ইসলাম-বিরোধী ও হিন্দুয়ানী কালচার। কোন মুসলিম নিজেকে ইসলামের-অনুসারী দাবি করার পর এসব কাজের সাথে যুক্ত হওয়া কিংবা সমর্থন যোগাতে পারে না।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে: وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْه
وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের অনুসরণ করতে চাইবে, কস্মিনকালেও তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে যারা মহা ক্ষতিগ্রস্ত সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”৫
সহীহ হাদিসে এসেছে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করলো, যা আমাদের ধর্ম-ইসলামে সমর্থিত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।৬
চার.
নিম্নে এমন কিছু 'আসার' উল্লেখ করছি, যেগুলোতে সুস্পষ্ট ভাবে নববর্ষ উদযাপনকে ইসলাম-বহির্ভূত, প্রত্যাখ্যাত ও নিষিদ্ধ কর্ম বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
১. হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি (বিধর্মী) কোন সম্প্রদায়ের অনুসরণ-অনুকরন করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে।”৭
এই হাদীসের ব্যখ্যায় শায়েখ মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ হাফি. বলেন: “সুতরাং বিধর্মীদের অনুষ্ঠান এবং বেদআত ও কুসংস্কার-মূলক কোন উপলক্ষ্য ও উৎসবে অংশগ্রহণ বৈধ নয়। মুসলমানদের দুই ঈদ– ঈদূল ফিতর ও ঈদুল আজহা ছাড়া বাৎসরিক অন্য কোন ঈদ ও উৎসব উদযাপন বৈধ নয়, যেমন কিছু কুসংস্কারবাদী লোকেরা জন্মদিন ও অন্যান্য উৎসব উদযাপন করে থাকে কিংবা বিভিন্ন বিধর্মী সম্প্রদায়ের অনুকরণে তারা যেসব দিবস ও উৎসব পালন করে থাকে। যেমন: ক্রিসমাস ডে, ম্যারেজ ডে, জন্মদিন, নববর্ষ-বরণ-উৎসব ইত্যাদি।৮
২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি বিধর্মীদের দেশে বসবাস করে, তাদের নববর্ষ ও উৎসব উদযাপন করে এবং তাদের অনুসরণ-অনুকরণ করে, অনন্তর এই অবস্থায় মারা যায়, কেয়ামতের দিন তাকে ঐ সমস্ত বিধর্মীদের সাথে উঠানো হবে।৯
পাঁচ.
পরিশেষে বলি, আমরা যারা ঈমানদার তাঁদের কর্তব্য হলো, নতুন-পুরাতন সকল মুশরিকদের লক্ষ্যে, মুসলিম-জাতির-পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস- সালাম এর আদর্শ অনুসরণ করে, তাঁর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে ঘোষণা দেয়া:
إِنَّا بُرَءَ ٰۤ ؤُا۟ مِنكُمۡ وَمِمَّا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ كَفَرۡنَا بِكُمۡ وَبَدَا بَیۡنَنَا وَبَیۡنَكُمُ ٱلۡعَدَ ٰوَةُ وَٱلۡبَغۡضَاۤءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤۡمِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَحۡدَهُۥۤ
“তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা করছো–তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের (আকীদা- বিশ্বাস) অস্বীকার করি। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালের শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে। যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।”১০
______
তথ্যসূত্র:
১. সূরা বাকার: ২০৮
২. সুরা বাকারা: ২০৯
৩. তাফসীরে ইবনে কাসীর: উক্ত আয়াত
৪. তাফসীরে ইবনে কাসীর ও তাফসীরে- তাওযিহুল কুরআন: সূরা কাফিরূন
৫. আলে ইমরান: ৮৫
৬. সহীহ মুসলিম
৭. সুনানে আবু দাঊদ
৮. দুরুসুশ-শায়খ মুহাম্মাদ আল মুনাজ্জিদ
৯. সুনানে কুবরা লিল বাইহাকি
১০. সূরা মুমতাহিনা: ৪
-এটি