উসমান বিন আব্দুল আলীম।।
কাউকে অপবাদ দেওয়া, লাঞ্ছনা, সম্মানহানি ও লজ্জিত করা ইসলামে যেমন নিষিদ্ধ, তেমনিভাবে সামাজিক দৃষ্টিতেও ঘৃণিত। এগুলো ব্যক্তির মান-মর্যাদাকে বিনষ্ট করে। সমাজে সেই ব্যক্তি হেয় প্রতিপন্ন হয়। ব্যক্তির সামাজিক পদমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
আমাদের সমাজে দলের হীনস্বার্থ ও কখনো বা ব্যক্তি বিদ্বেষের জন্য স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে এরকম হাজারো ঘটনা হরদম ঘটছে। এই পরিস্থিতি রীতিমতো মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। গল্প, গুজব, আড্ডা যত যাই হোক_সর্বত্রই অন্যের দোষ-চর্চা, অন্যের দুর্নাম, মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার মহড়া চলছে। বিশেষ করে ফেসবুকের মেসেঞ্জার গ্রুপ এর অন্যতম। এ-যেন অন্যের দোষ-চর্চায় দল বেঁধে নামা।
জানাশোনা-পরিচয় নেই তবুও একজনকে যাচ্ছেতাই বলা হচ্ছে। যারা শুনছেন তারাও কিছু বলছেন না। শুনে শান্তি পাচ্ছেন। একজন থেকে শুনে অমনিতেই ছড়িয়ে দেন আরেকজনের কাছে। একটুও যাচাই করার চেষ্টা করেন না যে, কথাটা কি আসলেই সঠিক ! নাকি মিথ্যা রটনা হচ্ছে।
যাচাই না করে বলে বেড়ানো এটা মিথ্যার শামিল। অথচ মিথ্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সবচেয়ে বড় গোনাহ কী, আমি কি তোমাদের জানাব না?’ সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল (সা.)। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা ও মাতা-পিতাকে কষ্ট দেওয়া। তিনি হেলান দিয়ে এ কথাগুলো বলছিলেন। এরপর সোজা হয়ে বসে বললেন, সাবধান এবং মিথ্যা কথা।’ (বোখারি ও মুসলিম শরিফ)।
কারও সম্মানহানি করা বা কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপের সুযোগ ইসলামে নেই। এটা ঘৃণিত অপরাধ। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘কোন পূতঃচরিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কেউ (ব্যভিচারের) অপবাদ দিয়ে যদি চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে অপবাদ রটনাকারীকে শাস্তি হিসেবে ৮০ বেত মারবে। আর কোনোদিন তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরা সত্যত্যাগী।’ (সুরা নুর : ৪)।
অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘যারা চরিত্রহীনতার মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তো তোমাদেরই একটি দল। (কিন্তু এই অপবাদে যাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে) তারা যেন নিজেদের জন্য বিষয়টিকে ক্ষতিকর মনে না করে। বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। (অপবাদ রটনাকারী) প্রত্যেককেই এ পাপের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এদের মধ্যে যে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন আজাব।’ (সুরা নুর : ১১)।
আবার কখনো দেখা যায়_আমি ও আমরা ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে অন্যজনকে লাঞ্চিত করছি, অপমান করছি। আচ্ছা একটু ভাবুন তো, এই লাঞ্চনা আর অপমান যদি আপনার ক্ষেত্রে হয়? আপনি অন্য এক মায়ের সম্মানহানি করছেন, কারো বোনকে লাঞ্ছনা করছেন, অথবা অন্যের স্ত্রীকে সমাজে লজ্জিত করছেন। হুবহু এই সম্মানহানি, লাঞ্ছনা, অপমান ও লজ্জিত যদি আপনার বোনের ক্ষেত্রে ,আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে ও আপনার মায়ের ক্ষেত্রে ঘটে, তখন আপনার কেমন অনুভব হবে?
অন্যকে লাঞ্চিত ও লজ্জিত করা ব্যক্তি সম্পর্কে
এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে যদি এমন স্থানে লাঞ্ছিত করে, যেখানে তার মানহানি ঘটে এবং সর্বদা খাটো করা হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে লাঞ্ছিত করবেন, যেখানে তার সাহায্যপ্রাপ্তির আশা ছিল।’ (আবু দাউদ)।
আপনি অন্য একজনকে কত জনের সামনে লাঞ্ছিত করছেন ? একটু ভাবুন তো যদি আল্লাহ তাআলা আপনাকে লাঞ্চিত করে তাহলে কত মানুষের সামনে লাঞ্চিত করবে!
একজন মুসলিম ভাই দোষ বা ভুল কাজ করতেই পারে। মানুষ বলতে মানুষের ভুল হয়। কিন্তু আমি ও আপনি একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত হলো; যদি সম্ভব হয় তাহলে সেই মুসলিম ভাইদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে তাদেরকে শোধরানোর চেষ্টা করা।উপদেশ দেওয়া। সেই ভাইয়ের জন্য দোয়া করা।
আর পাশাপাশি আমাদের কাজ হল সেই মুসলিম ভাই ও মা-বোনদের দোষ গোপন রাখা।
কেননা পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে; আল্লাহ কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। আল্লাহ শ্রবণকারী এবং বিজ্ঞ।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৪৮)
এক হাদীসে মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৪৫)
আর যে ব্যক্তি অপর মুসলমান ভাই ও মুসলিমা মা-বোনদের দোষ-চর্চায় লিপ্ত থাকে , তাদের ভুলগুলো প্রকাশ করে দেয়_ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে বা যে কোন কারনেই হোক না কেন_আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য শাস্তি রেখেছেন। তাদেরও আল্লাহ তাআলা এই দুনিয়াতে কোন এক সময় লাঞ্ছিত করবেন। আর আমরা তো জানি আল্লাহ তাআলা যদি আমাদেরকে লাঞ্চিত করে তাহলে কত বড় লাঞ্ছিত করবেন!
এক হাদীসে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম বলেন; ‘তোমরা মুসলমানদের দোষত্রুটি, ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের কোরো না। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় ও প্রকাশ করে দেয়, স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেন। আর আল্লাহ যার দোষত্রুটি প্রকাশ করেন, তাকে নিজের বাড়িতেই লাঞ্ছিত করেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৮৮০)
আজকাল নির্দোষ মানুষকে অপবাদ দেওয়া সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রচলিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন এর প্রথম বাহন, মানুষ একটা কথা শুনে এর সত্যায়ন না করে ছড়িয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এভাবে একটা ভিত্তিহীন কথা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বজুড়ে। অনুমান করে কিছু বলা বা কারও সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ বলেন; হে মুমিনরা, তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। (সুরা আল হুজরাত : ১২)।
তাই আসুন, আমরা অন্যের দোষচর্চা ছেড়ে দেই, অন্যকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া থেকে বিরত থাকি। ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে কাউকে লজ্জিত করা, লাঞ্ছনা করা ও সম্মানহানি করার মতো ঘটনা যেন আমাদের ধারা, অন্তত একজন মুসলিম হিসেবে যেন আমার ও আমাদের ধারা এই ঘৃণিত কাজ না হয়।
একটা কথা শুনেই তাহকিক বা সত্যায়ন না করে এটাকে আমরা না ছড়াই। আরেকটা বিষয় সবসময় খেয়াল রাখতে হবে; আমার ধারা যেন কোন ভাই বা কোন মা-বোন কষ্ট না পায় । সেদিকে সর্বোচ্চ খেয়াল রাখতে হবে।
এ বিষয়ে এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব : ৫৮)।
আল্লাহ তায়ালা আমাকে ও আমাদেরকে সঠিক বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, বলিয়ারপুর, সাভার,ঢাকা।
-এটি