মুফতি এনায়েত কবীর।।
পাহাড়ের চেয়ে ভারী, বাতাস থেকে গতিময় এবং জলোচ্ছ্বাসের চাইতে বেশী শক্তিশালী কোন জিনিস আছে কি? আগুনের দহন ক্ষমতা এবং লোহার চাইতে বেশী শক্তিধর কোন জিনিস হতে পারে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক। হ্যাঁ, কোনরকম লোক দেখানো মানসিকতা ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা দানের শক্তি এসব কিছুর চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী।
এটা কোন আবেগ উচ্ছ্বাসের কথা নয় বরং সত্যবাদী উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তির কথা। নবীজি ইরশাদ করেন, পৃথিবী সৃষ্টি করার পর তা দুলতে লাগল। তখন আল্লাহ তাআলা পাহাড় সৃষ্টি করে পৃথিবীর উপর দাঁড় করিয়ে দিলেন। পৃথিবী স্থির হয়ে গেল। পাহাড়ের শক্তি দেখে ফেরেশতাগণ বিস্মিত হলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন, হে রাব্বুল আলামীন!
আপনার সৃষ্টি জগতে পাহাড়ের চেয়ে ভারী আরো কোন জিনিস আছে কি? আল্লাহ উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আছে। তা হলো লোহা। ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে রব! লোহার চেয়ে শক্তিশালী কিছু আছে কি? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, আগুন। ফেরেশতাগণ বললেন, পরওয়ারদিগার। আপনার সৃষ্টির মধ্যে আগুনের চেয়েও বেশী শক্তিধর জিনিস কী? আল্লাহ তাআলা বললেন, পানি।
তারপর ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে পরওয়ারদিগার! সৃষ্টির মধ্যে বাতাসের চেয়েও শক্তিধর কিছু আছে কী? আল্লাহ তাআলা বললেন, হ্যাঁ, আছে। আর তা হলো দান খায়রাত। ডান হাতের এমন দান যা বাম হাত থেকেও গোপন থাকে। জামে তিরমিযী- ৩৩৬৯, শু‘আবুল ঈমান- ৩১৬৭ মিশকাতুল মাসাবিহ- ১৯২৩
হাদিসের শেষ বাক্য দ্বারা বুঝা গেল, দানের এই অতি আশ্চর্য শক্তি ও কার্যকারিতা পূর্বশর্ত হলো লোক দেখানো বা প্রসিদ্ধি লাভের মানসিকতা থেকে মুক্ত থাকা। দানের পরিমাণ বা সংখ্যার উপর এই শক্তি নির্ভরশীল নয়। বরং পরিশুদ্ধ নিয়ত ও ইখলাসের সাথে করা দানের পরিমাণ কম হলেও এই শক্তি অর্জন করা সম্ভব। এক হাদীসে নবীজি ইরশাদ করেন, এক টুকরো খেজুর সদকা করে হলেও তোমাদের এবং জাহান্নামের মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করো। তিরমিজি : ১৬২৫
রমজান হলো নেক আমলের বসন্তকাল। তাই অন্যান্য আমলের পাশাপাশি দান খায়রাতের মাধ্যমেও মুক্তির পথকে প্রশস্ত করা সহজ। নবীজী বলেন, দানকারী আল্লাহর নিকটতম, বেহশতের নিকটতম এবং মানুষের নিকটতম হয়ে থাকে। আর দূরে থাকে জাহান্নাম থেকে। অপরদিকে কৃপণ ব্যক্তিআল্লাহ, বেহেশত এবং মানুষ থেকে দূরে থাকে। আর কাছাকাছি থাকে জাহান্নামের। অবশ্যই একজন মূর্খ দাতা একজন কৃপণ ইবাদতকারীর তুলনায় আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সহীহ বোখারি : ১৮১৩
এই মাসে আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি নফল আমলের সওয়াব ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেন। সে হিসাবে রমজানে ১ টাকা দান করে ৭০ টাকা দানের সওয়াব লাভ করা সম্ভব। এক টাকা বিনিয়োগ করে আশি ডলার পেলে আমরা কি তখন বসে থাকবো? তাই আমাদের আমলনামাকে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী করার স্বার্থে অসহায় ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য দানের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
হজরত ইবনে আব্বাস রা থেকে বর্ণিত। নবীজি ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল। রমজানে তিনি মুক্ত বাতাসের চেয়েও বেশি দান করতেন। সহীহ বোখারি : ৩২২০।
আমাদের সমাজের একটি ব্যাপক অসুস্থ মানসিকতা হলো দানগ্রহীতাকে তুচ্ছ ভাবা। অথচ গ্রহীতা আমার টাকা গ্রহণ করেছে বলেই তো আমি দানের ইবাদত করতে পারলাম। এইজন্য তো তাকে সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। তাছাড়া দানের মাধ্যমে আমি তাকে যতটুকু উপকার করেছি এর চেয়ে বেশি উপকার তো আমার নিজের। কিভাবে?
নবীজী বলেন, কেয়ামতের দিন সদকা মুমিনের জন্য ছায়া হিসেবে কাজ করবে। মুসনাদে আহমদ: ১৩৫১ এখানে কার লাভবান হওয়ার কথা বলা হয়েছে?
দান বা উপকার কেন্দ্রিক আমাদের আরেকটি দুর্বলতা দিক হলো, দানগ্রহীতার কাছ থেকে কৃতজ্ঞতার বাক্য বা আচরণ প্রত্যাশা করা। অথচ এমন মানসিকতা রাখা উচিত নয়। তাহলে দাতার কি মানসিকতা রাখা উচিত? কুরআনে পাকে রয়েছে এর জবাব। আল্লাহ তা'আলা বলেন, দান বা উপকার কারি লোকেরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদেরকে খাবার দেই আর তোমাদের কাছ থেকে কোন প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। সুরা দাহার- ১০।
তবে ইসলাম দানের ব্যাপারে উৎসাহিত করলেও পরনির্ভরতাকে নিরুৎসাহিত বেশ জোরালোভাবে।
-এটি