সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


রমজান হোক নতুন করে সাজাবার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইসমাঈল হাবীব।।

রমজান।মহাপুণ্যের মাস।মহাপ্রাপ্তির মাস।রমজান এলে পুন্যতায় ভরে ওঠে প্রতিটি প্রহর। রমজানের ছোঁয়ায় সবকিছু কেমন বদলে যায়। হৃদয় নতুন করে জাগতে শুরু করে। পবিত্রতায় হৃদয় উদ্বেলিত হয়। মনের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে আশার দীপ জ্বলতে থাকে। সকাল সাঁঝে সন্ধ্যায় নিশিপ্রহরে ইবাদত আরাধনায় হৃদয় ব্যকুল হয়ে ওঠে।প্রভুর কাছে মিনতিকন্ঠে গোনাহ মাফের আর ওঠে বারেবারে।

রমজানের প্রথম দিনেই মুমিনের হৃদয় আবেগাপ্লুত হয়। ইবাদতের দ্যুতিতে ভাস্বর হয়ে ওঠে প্রতিটি মসজিদকোণ। শতশত খুনে রাঙানো হাতটিও আল্লাহর দরবারে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ফরিয়াদ জানাতে থাকে। তার চোখ বেয়েও ঝরতে থাকে অবিরল অশ্রুধারা। রহমতের আশায়, মাগফিরাত কামনায়, নাজাত লাভে বারবার ছুটে আসে মসজিদে। মসজিদের কোণটাই হয়ে পড়ে তাঁর সারাক্ষণের অবস্থান।

শেষরাতের অশ্রু মুনাজাতে দু'চোখের তারায় চিরসবুজ জান্নাতের ছবি ভেসে ওঠতে থাকে।জান্নাত প্রাপ্তির প্রত্যাশায় তনুমন উদ্বেলিত হতে থাকে।পরক্ষণে যখন জাহান্নামের দৃশ্য মনে পড়ে উৎকন্ঠায় বুকটা ধরফর কেঁপে উঠে।

রমজানের পবিত্র ছোঁয়ায় পাপিষ্ঠ দুষ্টলোকটাও আল্লাহওয়ালা হয়ে যায়।তাঁর চোখেমুখে ঈমানের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়। রমজানের আগমণে তারা হয়ে যান সরলমনা। বিনয়ী। ইবাদতগুজারী। জান্নাতি মানব।

প্রকৃতির কোলে বসন্ত যেমন, মুমিনের কাছে রমজানও তেমন। রমজান আসে অনেক প্রতীক্ষার প্রহর কাটিয়ে। রমজান আসে অনেক উপহার প্রাপ্তি ও পুরষ্কারের ঘোষণা নিয়ে। আবার তোমার অপেক্ষিত দুয়ারে রমজান কড়া নাড়ছে।

আল্লাহ কত সুন্দর করে রমজানের কথা কোরআনের পাতায় তুলে ধরেছেন; রমজান মাস— যে মাসে নাযিল হয়েছে পবিত্র কুরআন। মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য, সুস্পষ্ট দলীল হিসেবে।তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে। (সূরা বাকারা আয়াত নং ১৮৫)

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ ঘোষণা আসার পর যখনই রমজান আসত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের পরিমাণ অনেক অনেক বাড়িয়ে দিতেন।হযরত জিবরিল আমীন নবীজির সাথে কুরআন শরীফ 'দাওর' করতেন। তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে কুরআন শোনাতেন।

রমজান এলে নবীজি দানশীল হয়ে ওঠতেন। মুক্ত প্রবহমান বাতাসের মতো তিনি দান করতেন—অর্থাৎ দু'মুঠো ভরে ভরে তিনি দান করে যেতেন—ইয়াতীম দরিদ্রদের মাঝে।

হাদীসে শরীফে এসেছে—তিনি ছিলেন সবচে' বড় দানশীল। আর রমজান এলে আরো বড় দানশীল হতেন।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে দেখে সাহাবায়ে কেরামেরও অনুরূপ দান করতেন।তাঁরা অনুসরণে কেবল রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
দেখতেন।দান দাক্ষিণার সাথে সাথে হয়ে ওঠতেন সিয়াম সাধনায় আলোকিত মানুষ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন;

হে' মুমিনগণ! তোমাদের উপর রমজানের রোযা ফরজ করা হলো। যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।(সূরা বাকারা—১৮৩)

এ ঘোষণা শোনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে রোযা রাখতে আরম্ভ করেন। সিয়াম সাধনায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন। তারা প্রিয় রাসুলের মুখে শুনেছিলেন— 'রোযাদার আল্লাহ তাআলার সবচে নিকটবর্তী। মুত্তাকী হওয়ার আসল পথ। এভাবেই তারা রোযাকে তারা নিজেদের জীবনে অতিআপন করে গ্রহণ করেছিলেন।

ইবাদতের ধারাবাহিকতা অবিচ্ছন্নভাবে চলতে থাকতো। প্রিয় নবীজির ইবাদত-ব্যকুলতা দেখে সাহাবায়ে কেরাম ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়তেন, অনুরূপ ইবাদত করতে চাইতেন। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কঠোরভাবে বারণ করে বলতেন। لست كهيئتكم , اني أبيت عند ربي يطعمني ويسقيني

আমি তো তোমাদের মতো নই।আমি তো আমার রবের কাছে রাত কাটাই( তাঁর ইবাদতে মিশে একাকার হয়ে যাই) তিনিই আমাকে পানাহার করান।

রমযান মাসের বিশেষ মুহূর্তগুলোর অন্যতম মুহূর্ত হলো সাহরীর মুহূর্ত আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহরী খেতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে সাহরী খেতে বলতেন; তোমরা সকলে মিলে সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে রয়েছে অনেক বরকত।(মুসলিম শরীফ হাদীস নং—৩৫০)

নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরি খেতেন সুবহে সাদিকের আগ মুহূর্তে অর্থাৎ রাতের শেষ ভাগে। এ সময় সাহরি খাওয়া নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক পছন্দ করতেন।সাহাবি হযরত যায়েদ বিন সাবেত (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সাহারী খেতাম, এরপর তিনি নামাজের জন্য দাঁড়াতেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফজরের আজান ও সাহরির মাঝে কতটুকু ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, পঞ্চাশ আয়াত (পাঠ করা) পরিমাণ। (বুখারি, হাদিস : ১৯২১)

রমজান মাসে নবীজির আরও আমল ছিলো, যথাসময়ে ইফতার করা। হজরে সফরে কিংবা রণক্ষেত্রে যেখানেই থাকতেন ইফতার করতেন।এটি ছিল নবীজির আমল সময় হওয়ার সাথে সাথে খেজুর কিংবা অন্যকোনো খাবারের মাধ্যমে রোজা ভাঙতেন।একবারের ঘটনা, সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রমজান মাসে কোনো এক সফরে আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো এদিকে সূর্যও ডুবে গেল— তিনি আমাদের একজনকে বললেন; হে অমুক! অবতরণ করো এবং আমাদের জন্য ছাতু গুলে আনো।

সে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এখনো দিন রয়ে গেছে।তখন তিনি পুনরায় বললেন, অবতরণ করো এবং আমাদের জন্য ছাতুগুলে আনো। তখন সে অবতরণ করলো এবং ছাতুগুলে তাঁর নিকট পেশ করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করলেন এবং হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে বললেন, সূর্য এদিক থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং রাত যখন এদিক থেকে ঘনিয়ে আসবে, তখন সিয়াম পালনকারী ইফতার করবে। (মুসলিম, হাদিস : ২৪৪৯)

রমজানের আরেক বিশেষ আমল হলো তারাবিহ। তারাবির ফজিলত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন , যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকী লাভের আশায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবিহ আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার রমজানে রাতেরবেলায় মসজিদে নববীতে নামাজ তারাবিহ আদায় করলেন।উপস্থিত লোকেরাও তার সাথে নামাজে শরীক হলেন।

একইভাবে তারা দ্বিতীয় দিনেও নামাজ আদায় করলেন এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলো। অতঃপর তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো।

কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স.) হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের কাছে এলেন না। অতঃপর সকাল তিনি বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আমি শুধু এ ভয়ে তোমাদের নিকট আসা থেকে বিরত থেকেছি যে, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, না জানি তোমাদের ওপর এটা (তারাবি) ফরজ করে দেওয়া হয়। (বুখারী শরীফ)

রমজান মাসে নবীজি তাহাজ্জুদে আমল বাড়িয়ে দিতেন প্রথম রাতে তারাবিহ শেষ করে রাতের শেষ অংশে আবার তাহাজ্জুদের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তাহাজ্জুদ নামাজের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেছেন; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে ও অন্যান্য সব মাসের রাতে এগারো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন।

এ চার রাকাত আদায়ের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর আরো চার রাকাত সালাত আদায় করতেন।এ চার রাকাতের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিন রাকাত আদায় করতেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি বিতির সালাত আদায়ের পূর্বে ঘুমিয়ে পড়েন? নবী (সা.) বললেন, আমার চোখ ঘুমায়, আমার অন্তর ঘুমায় না। (বুখারি, হাদিস : ৩৫৬৯)

কালের সিঁড়ি বেয়ে আবার আমাদের দুয়ারে সিয়াম সাধনার মাস রমজান এসেছে। চারদিকে ঈমানের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে।রমজানের আগমণে হৃদয় দোলা দিয়ে উঠছে।

রমজান আসে রহমত ও বরকত নিয়ে!
রমজান আসে পুন্য ও পবিত্রতা নিয়ে!
রমজান আসে ক্ষমা ও মহামুক্তি নিয়ে!

তাই আসুন—রমজানকে আকড়ে ধরি জীবনে পরম সৌভাগ্যরূপে। রমজানকে ধারণ করে জীবনের ভাঁজে ভাঁজে। রমজানকে ভালবাসি যেমন ভালবাসে ছিলেন প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও প্রিয় সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুম। আমাদের রমজান হোক—চেতনার প্রেরণার!

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ