বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর ৪৫ তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষা প্রশ্নপত্রের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চর্চা হয়েছে। এ বিষয়ে আলেম শিক্ষাবিদগণ বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন।
পরীক্ষার সময় হঠাৎ করে আলোচনায় আসা বিষয়টি নিয়ে বোর্ডের দায়িত্বশীলগণ আসলে কি ভাবছেন? এ বিষয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন বেফাকের সহ-সভাপতি ও জামেয়া হুসাইনিয়া গওহরপুর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন গহরপুরী।
আলোচনায় শিক্ষাবোর্ড এবং মাদ্রাসাগুলোর ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ, এলমে দ্বীন হাসিলের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম।
শিক্ষার্থীদের কিছু অংশের মাঝে প্রশ্ন কঠিনের একটা কথা উঠেছে, অপর অংশ আবার এই দাবিকে অযৌক্তিক বলছে- বেফাকের একজন দায়িত্বশীল হিসেবে বিষয়টি কিভাবে দেখছেন আপনি?
প্রশ্নপত্র যতই সহজ করা হোক, একটি অংশ থাকবে যারা সবসময় বলবে প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। এখানে এমন পরীক্ষার্থীও রয়েছে যারা হয়তোবা তিনটি প্রশ্ন হল করে এসেছে এর বাইরে চতুর্থ কোন প্রশ্ন আসলে তারা প্রশ্ন উঠাবে প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। প্রশ্ন আমাদের পড়াশোনার বাইরে থেকে এসেছে। এটাই স্বাভাবিক অনেকে অনেক ধরনের প্রশ্ন তুলবে।
বাকি এখানে প্রশ্ন কঠিন অথবা সহজ; বিষয়টি এমন নয়। আমাদের কওমি মাদরাসার যে ঐতিহ্য এখানে দ্বীন বোঝা এবং শেখা হলো মূল বিষয়। এবাদত হিসেবে এখানে পড়াশোনা হয়, পাশ ফেল এখানে মূল বিষয় নয়। শিক্ষার্থীদের কিতাব হল থাকলে প্রশ্ন কঠিন সহজের বিষয়টি সামনে আসে না।
করোনার বছর হিসেবে অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রশ্ন সহজে হয়েছে বলা যায়। এরপরও একটা বিষয় থাকে যে, প্রত্যেক বছরই কিছু শিক্ষার্থী থাকে যারা ফেল করে।
ট্রেন সময়মতো ছাড়লেও কিছু যাত্রী থাকবে যারা সময়মতো পৌঁছাতে পারবে না, ট্রেন ফেল করবে। এটাই স্বাভাবিক।
হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা সরাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- এমন একটা কথা বলতে শোনা গেছে- এ বিষয়ে কি বলবেন?
বর্তমানে শিক্ষার্থীদের যে গাইড নির্ভরতা এটা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। অথচ এর আগের চিত্রটা ছিল পুরোই ভিন্ন। যেখানে শিক্ষার্থীরা কিতাব নিয়ে পড়ে থাকত, কিতাব হল করার চেষ্টা করতো। কিন্তু আস্তে আস্তে কিতাব থেকে সরতে সরতে এমন হয়ে গেল যে অনেক শিক্ষার্থী সিয়া সিত্তার কিতাবগুলোও ঠিকমত চেনে না। গাইড এর উপর নির্ভর করে তারা পড়ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে। এখন এই বিষয়টা থেকে তো শিক্ষার্থীদের বের করে নিয়ে আসতে হবে। তাই দায়িত্বশীল জায়গাতে থেকে বোর্ড বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে এটাই স্বাভাবিক। এখন পদক্ষেপ নিতে গিয়ে তো বোর্ড আর শিক্ষার্থীদের সাথে পরামর্শ করে প্রশ্ন সাজাবে না।
তাছাড়া শিক্ষার্থীরা তো পড়াশোনার বিষয়ে নিজেরাই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অনেক শিক্ষার্থী তো আছে যে তাদের মনমতো সব কিছু হোক, এটাই চায় তারা। আসলে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কোনটা তাদের জন্য ভালো কোনটা মন্দ। শিক্ষাজীবন পেরিয়ে অনেক সময় তাদের বুঝে আসে উস্তাদদের করা নিয়মকানুনগুলো তাদের ভালোর জন্যই ছিল।
আরেকটা বিষয় হলো বোর্ড তো আলাদা কিছু নয়, যারা মাদরাসাগুলোতে পড়ান তারাই বোর্ডের দায়িত্বে রয়েছেন। এক্ষেত্রে মাদরাসা বোর্ড সবাইকে মিলিয়ে কাজ করতে হবে। বোর্ড কিতাবের প্রতি ছাত্রদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে বেফাক যে খুব তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ নিচ্ছে বিষয়টা এমন নয়। বরং আস্তে আস্তে কাজ করে যাচ্ছে, সামনে আরো করবে।
শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা বন্ধে বোর্ডকেই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মতামত দিচ্ছেন শিক্ষাবিদগণ- বোর্ড আসলে কি ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে সামনে এগোবে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাইবেন কি?
আসলে গাইড-এর সাথে বোর্ডের কোন সম্পর্ক নেই। বোর্ড-এর মূল কাজ হচ্ছে সিলেবাস তৈরি এবং শিক্ষা কেন্দ্রিক কাজগুলো করা। ছাত্ররা কোন কিতাব কিভাবে হল করবে, কিভাবে যোগ্যতা অর্জন করবে এ বিষয়টির দায়বদ্ধতা বর্তাবে যে শিক্ষক পড়াচ্ছেন তারেউপর। তিনি শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভর করে তুলছেন নাকি মতন-এর সাথে সম্পর্ক করে দিচ্ছেন এটাই মূল বিষয়।
মাদরাসা থেকে পড়াশোনা করে পরবর্তীতে বিষয়টি বেফাকের কাছে আসে। আর বেফাক তো বলতে গেলে আলাদা কিছু না।
বোর্ড তো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও পড়াশোনার উন্নয়ন কেন্দ্রীক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। একজন শিক্ষার্থী গড়ে ওঠে মূলত মাদরাসা থেকে। তাই শিক্ষার্থীদের এই গাইড আসক্তির বিষয়টির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (মাদরাসাগুলোর) কোন দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে করেন কিনা?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজই তো হলো শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করা। বোর্ড বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারে কিন্তু প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে বাধ্যবাধকতা করা বোর্ডের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক মাদ্রাসা আছে যেখানে বোর্ডের জামাতগুলোতে পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে পড়াশোনা করানো হয়। তাই মাদ্রাসাগুলোর এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া বোর্ড চেষ্টা করে যাচ্ছে শিক্ষার উন্নয়ন মূলক কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য।
গাইড আসক্ত শিক্ষার্থীদের সহজেই এ থেকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন কি?
দেখুন মাদ্রাসাগুলোতে বর্তমানে যে সময়টা যাচ্ছে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ এ সময়টাতে বোর্ড পরীক্ষা চলছে। দেখবেন এই সময়েও অনেকে সামাজিক মাধ্যমে সে পরীক্ষা নিয়ে ধরনের মতামত দিচ্ছে, যে আজকের পরীক্ষাটা অনেক ভালো হয়েছে অথবা আজকে টা খুবই খারাপ হয়েছে।
আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে যে, অনেক শিক্ষার্থী পরিবার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবার থেকেই এক ধরনের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াশোনায় মগ্ন। আমাদের আকাবিরদের জীবনী থেকেও আমরা এমন অনেক কিছু জানতে পারি যে তারা বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন শুধু পড়াশোনার পেছনে। পরিবারের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে।
এখন আমরা শিক্ষার্থীদের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই বিষয়টা এমন না-মূলত তাদেরকে পড়াশোনার সাথে আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে চাই। এক্ষেত্রে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
এখানে আমি মূল কথা বলতে চাই আমাদের পড়াশোনাটা পরীক্ষা কেন্দ্রীক না। এর পুরোটাই ইবাদত এবং দ্বীন শিক্ষা করা। তাই এখানে পরীক্ষায় পাশ ফেলের বিষয়টা মুখ্য নয়। শিক্ষার্থীরা যোগ্য হয়ে উঠল কিনা এটাই মূল বিষয় তাই শিক্ষার্থীদের কিতাবের সঙ্গে মুনাসাবাত করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বোর্ড।
-কেএল