।।কাজী আব্দুল্লাহ।।
এবার বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী মুসলিমের স্থানে জায়গা করে নিলেন ইউঘুরদের অধিকার আদায়ে লড়াই করা চীনা মুসলিম ইলহাম তোহতি।
আম্মানে অবস্থিত দ্যা রয়েল ইসলামিক ষ্ট্র্যাটেজিক ষ্টাডিজ সেন্টার নামক প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত তালিকায় এমনটিই দেখা গেছে।
প্রতি বছরই বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের তালিকা তৈরী করে প্রতিষ্ঠানটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল সেন্টার ফর মুসলিম- ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারষ্ট্যান্ডিং নামক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তালিকাটি প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
ইলহাম তোহতির জন্ম ১৯৬৯ সালে জিনজিয়াং প্রদেশের আরতুশ শহরের একটি উইঘুর পরিবারে। ১৯৮৫ সালে তার শিক্ষা জীবনের যাত্রা শুরু হয় এবং তিনি চীনের সেন্ট্রাল মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপকও হতে সক্ষম হন। উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত এত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান না। এর পেছনে দায়ী উইঘুরদের উপর চীনের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন। তবে তোহতির ভাগ্য ভালো হওয়ায় তিনি তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও তিনি নিজ সম্প্রদায়কে ভুলে যাননি বরং প্রায় দুই যুগ ধরে উইঘুর ও হান চীনাদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। জিনজিয়াংয়ে মুসলিমদের উপর যেসব অত্যাচার করা হত তা সবকিছুই তিনি স্পষ্টভাবে সকলের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। ফলে ১৯৯৪ সালে থেকে তার উপর সরকারি নজরদারি শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে তাকে হয়রানির শিকারও হতে হয়।
তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেও তোহতিকে দমানো যায়নি। নজরদারির মাঝেই বহির্বিশ্বে উইঘুরদের অবস্থা তুলে ধরতে সহায়তা নেন ইন্টারনেটের। উইঘুরদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করতে থাকেন তিনি।
সে ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে তৈরি করেন ‘উইঘুরবিজ.নেট' নামক ওয়েবসাইট। উইঘুরের সকল সমস্যা ও তাদের উপর নিপীড়নের ঘটনাগুলো ‘উইঘুরবিজ.নেট'-এ তুলে ধরা হয়। তবে ওয়েবসাইটটি বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধও করে দেওয়া হয়। আর যারা ওয়েবসাইটটির জন্য লেখালেখি করতেন তাদেরকেও বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদে নির্যাতন করা হতো। পুরোপুরি না হলেও ওয়েবসাইটটির আংশিক অস্তিত্ব এখনও টিকে আছে।
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নির্যাতিত সম্প্রদায় হিসেবে যদি জরিপ চালানো হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলিমদের নাম সবার আগে আসবে। শুধুমাত্র তাদের ধর্ম ইসলাম এবং সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে যুগ যুগ ধরে তারা নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। তুর্কিদের সাথে উইঘুরের জাতিগত সামঞ্জস্য থাকলেও চিনের সঙ্গে এই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত ভিন্নতা হওয়ায় কখনোই তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ কারণেই উইঘুর সম্প্রদায়ের এই স্বাতন্ত্র্য ও অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। আর এজন্য তারা একটি ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। উইঘুর মুসলিমদেরকে চীনের সাধারণ জনগণের সাথে বসবাসের এবং চীনের সংস্কৃতি বোঝার উপযোগী করে তোলার নামে জোরপূর্বক পাঠানো হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্প বা বন্দী শিবিরে।
যদিও চীন সরকার- এ বন্দি শিবিরকে ‘চরিত্র সংশোধনাগার’ নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উশৃংঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম এবং এসব ক্যাম্পে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলিমেরা স্বেচ্ছায় শিক্ষাপ্রাপ্তির জন্য যাচ্ছেন। তবে সেই ক্যাম্পে যাওয়ার ব্যাপারে এবং সেখান থেকে ফিরে আসা উইঘুরদের বক্তব্য একদমই ভিন্ন। তারা বলছে তাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার মতো অমানবিক পদক্ষেপের আশ্রয়ও নিয়েছে চীন। এ নিয়ে চিনা সরকারের সমালোচনা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।
উইঘুর সম্প্রদায়ভুক্ত ইলহাম তোহতিও এই সমালোচনা কোনো অংশেই কম করেননি। চীনের সেন্ট্রাল মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক তোহতি চীনের সাথে উইঘুরের সম্পর্কের উপর গবেষণা এবং উইঘুরের উপর অত্যাচারের সকল খবরাখবর বিশ্ববাসীর নিকট পৌঁছে দেওয়ার সুবাদে সকলের নিকট পরিচিত হয়ে ওঠেন। সকল বাঁধা উপেক্ষা করে নিজ সম্প্রদায়ের জন্য তার স্বাধীনচেতা মনোভাবই একসময় তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে চীন সরকার তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। যার কারণে চীনের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী নিজ দেশেই সন্ত্রাসী ও অপরাধী হিসেবে গণ্য হতে থাকেন। তবে চীনের দেয়া এই শাস্তির পরেও দমে যাননি তোহতি। বরং নিজ আত্মত্যাগ এবং উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে দেন সমগ্র বিশ্বে। তার এই স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে ২০১৯ সালে তোহতিকে তার কাজের জন্য সম্মান প্রদর্শন করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তাকে ভূষিত করে শাখারভ পুরস্কারে।
তোহতির শাখারভ পুরস্কার প্রাপ্তি
প্রতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার জন্য শাখারভ পুরস্কার প্রদান করে থাকে। ২০১৯ সালে ইলহাম তোহতিকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। তবে তার অনুপস্থিতিতে তার মেয়ে স্ট্রাসবার্গ গিয়ে তার পুরস্কার গ্রহণ করেন। এসময় তোহতির মেয়ে জওহার ইলহাম তার পিতা ও উইঘুর সম্প্রদায়ের উপর যে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে সেই সম্পর্কে বলেন।
এতো বছর ধরে শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতা ব্যবহার করার ফলে ইলহাম তোহতিকে গ্রেফতার করে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বহির্বিশ্বে নিজেদের ইমেজ ঠিক রাখতে উইঘুর মুসলিমদের উপর গোপনে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে চীন। আর এসব ব্যাপারে প্রতিবাদ করা ইলহাম তোহতির মত স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের বন্দী বানানো হচ্ছে যেনো নিজেদের অপকর্ম প্রকাশ না পায়।
২০১৭ সালের পর থেকে তোহতির সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও দেখা করার সুযোগ পান না। তিনি ঠিক কোথায় আছেন, কেমন আছেন সেসব তথ্যও রয়ে গেছে সকলের অগোচরে।
-কেএল