বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে দেশ: ফখরুল চক্রান্তের ফাঁদে না পড়ে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণের আহ্বান শায়খ আহমাদুল্লাহর ভোলায় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদদের স্মরণে দোয়া ও স্মরণসভা চরমোনাইর বার্ষিক অগ্রহায়ণ মাহফিল বুধবার, চলছে সর্বশেষ প্রস্তুতি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান আসিফ মাহমুদের অসহায় শীতার্তের পাশে মাওলানা গাজী ইয়াকুবের তাকওয়া ফাউন্ডেশন দেশের তিন জেলায় শিক্ষক নিচ্ছে ‘আলোকিত মক্তব’ বৃদ্ধার দাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল প্রতিবন্ধীদের ধর্মীয় ও কারিগরি শিক্ষা দিতে পারলে দেশ এগিয়ে যাবে: ধর্ম উপদেষ্টা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্র সফল হবে না: মাওলানা আরশাদ মাদানী

নবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কুরআনী নির্দেশনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা আসজাদ ক্বাসেমী নদবী
‎অনুবাদ: মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ ‎

কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মুসলিম উম্মাহ কে আদেশ করা হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ‎ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সম্মান এবং শিষ্টাচারের সাথে আচরণ করতে, রাসূল সা. কে মর্যাদা দিতে ‎এবং রাসূলের ইহতিরাম করতে।

গুরুত্বসহ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন এমন কোনো আচরণ না ‎পাওয়া যায়, যা আদবের খেলাফ এবং নববী দায়িত্ব ও মর্যদার সাথে বে-মানান। কুরআনের গভীর ‎মুতালাআ থেকে বুঝা যায়, রাসূলের সম্মানের ব্যাপারে মৌলিক পাঁচটি বিষয়ে মুসলিমদের কে ‎আদেশ করা হয়েছে। নিচে সেই পাঁচটি দিক তুলে ধরা হলো। ‎

১. নাম ধরে ডাকার নিষেধাজ্ঞা। কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা একে অপরকে যেভাবে ডাকো, রাসূল সা. কে সেভাবে ডেকো না” ‌‎(সূরা নূর, আয়াত: ৬৩) ‎এই আয়াত দ্বারা তিনটি বিষয় উদ্দেশ্য হতে পারে। ‎

‎(ক) রাসূলের আহ্বান কে সাধারণ মানুষের আহ্বানের মতো মনে করো না; বরং রাসূলের আহ্বান ‎অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলের আহ্বান বিচারক সুলভ আহ্বান। (রাসূল সা. ডাকলে আসা আবশ্যক ‎হয়ে যায়। আয়াতের পূর্বাপর থেকে এই তাফসীরই অগ্রগণ্য। তাই বয়ানুল কুরআন এবং ‎তাফসীরে মাযহারী তে এই তাফসীর পছন্দ করা হয়েছে। মাআরিফুল কুরআন: ৬/৪৫৫। ‎অনুবাদক)

‎(খ) রাসূলের দুআ কে সাধারণ মানুষের দুআর মতো মনে করো না; বরং রাসূলের দুআই সবচেয়ে ‎বড় নিয়ামত। আর রাসূলের বদদুআ সবচেয়ে ভয়াবহ। ‎

‎(গ) রাসূল সা. কে একজন সাধারণ মানুষের মতো করে ডেকো না। বরং চূড়ান্ত আদবের সাথে ‎সম্মানসূচক শব্দে ডেকো। ‎

আয়াতের তিনটি উদ্দেশ্যের মধ্যে এই তৃতীয় উদ্দেশ্যটিই অগ্রাধীকার প্রাপ্ত। আব্দুল্লাহ ইবনু ‎আব্বাস রা. এর বর্ণনা হতে এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মানুষ রাসূল সা. কে “হে ‎মুহাম্মাদ” “হে আবুল কাসেম” জাতীয় শব্দে ডাকতো। স্বীয় নবীর সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে ‎আল্লাহ তাআলা মানুষদের কে এভাবে ডাকতে নিষেধ করেছেন। “হে আল্লাহর নবী” “হে আল্লাহর ‎রাসূল” জাতীয় শব্দ দ্বারা ডাকতে আদেশ করেছেন”। (তাফসীরু ইবনি কাছীর:৫/১৩০) ‎

বিখ্যাত মুফাসসির ক্বাতাদা বলেন, ‘এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের কে আদেশ ‎করেছেন তাঁর নবীর ইহতিরাম-আযমত, সম্মান-মর্যাদা, ভয় ও শ্রদ্ধা এবং তাঁর বড়ত্ব ও মহিমা ‎নিজেদের অন্তরে সুদৃঢ়ভাবে গেঁথে রাখতে’। ‎

সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, ‘অন্তরসমূহে রাসূলের সম্মানের তরঙ্গ ‎থাকা আবশ্যক। রাসূল সা. এর শানে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের সাথে ইহতিরাম ও মর্যাদার মাধুর্য ‎টপকানো একান্ত জরুরী। রাসূল সা. এর জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকা অপরিহার্য। রাসূল সা. এর ‎বিনয়ী আর নম্র হওয়া তাঁর বিশেষ গুণ, সেটা স্বস্থানেই আছে। কিন্তু উম্মাতের অন্তরে তাঁর ‎আযমত ও সম্মান থাকা এবং মুখের সাহায্যে সেই সম্মান আর মর্যাদার প্রকাশ অনেক বেশি ‎গুরুত্বপূর্ণ”। (ফী যিলালিল কুরআন: ৪/২৫৩৫) ‎

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ বলেন, “তোমাদের পরস্পরের আহ্বান এবং ডাকা কে যেমন মনে ‎করো, আল্লাহর রাসূল সা. এর আহ্বান ও ডাককে তেমন মনে করবে না। বরং তাঁর প্রতিটি আহ্বান ‎তোমাদের জন্য একেকটি আইন এবং তা মানা আবশ্যক। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি ‎কোনো দলের নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তার আহ্বানও গুরুত্বের সাথে শুনতে ‎হবে; নচেত দলের শৃঙ্খলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে”। (তরজুমানুল কুরআন:৪/১০০৬) ‎

২. রাসূল সা. থেকে আগে বেড়ে যাওয়া থেকে নিষেধাজ্ঞা।‎ কুরআনে বলা হয়েছে, “হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের থেকে আগ বেড়ে যেওনা। ‎আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন”। (সূরা হুজুরাত: ‎১)‎

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সালাফ থেকে অনেকগুলো বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। নিচে কয়েকটা উল্লেখ ‎করা হলো। ইবনু আব্বাস রা. বলেন, “কুরআন-সুন্নাহর বিরোধিতা করবে না। কুরআন-সুন্নাহর বিরোধি কিছু ‎বলবে না”। (তাফসীরে তাবারী: ২৬/৭৪) ‎

ইমাম দাহহাক রহ. বলেন, “জিহাদ ও অন্যান্য শরয়ী বিধানের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ‎বিধানের বিপরিতে নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না”। (তাফসীরে বাগাবী: ৪/২০৯) ‎

ইমাম ইবনু জারীর রহ. বলেন, “নিজেদের জিহাদ ও দ্বীনী বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ‎সিদ্ধান্তের পূর্বে তাড়াহুড়া করে নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত করবে না। যেন আল্লাহ ও রাসূলের ‎ইচ্ছার বিরোধি এবং হক্ব ও সত্যের বিপক্ষে কিছু করা না হয়ে যায়। ‘লা তুকাদ্দিমু’ বা ‘আগ বেড়ে ‎যেওনা’ আরবী ভাষায় আদেশ-নিষেধে তাড়াহুড়া করার অর্থে ব্যবহৃত হয়”। (তবারী: ২৬/৭৪)‎

কুরতুবী রহ. বলেন, “কথায় ও কাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে অগ্রবর্তী হবে না। রাসূল থেকে ‎আগ বেড়ে যাওয়া মানে আল্লাহ থেকে আগ বেড়ে যাওয়া; কারণ রাসূল তো আল্লাহর কথাই ‎পৌঁছান”। (আল-জামে লিআহকামিল কুরআন: ১৬/৩০০)

ইবনু কাছীর রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহ ও ‎তাঁর রাসূলের অনুগামী হয়ে যাও। (তাফসীরু ইবনি কাছীর: ৪/২৪০) ‎

এই বিভিন্ন বক্তব্যে মূলত কোনো বিরোধ নেই। আয়াতে সবধরণের অগ্রবর্তীতা এবং আগ বেড়ে ‎যাওয়াকে নিষেধ করা হয়েছে। প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান কে নিজের ‎সিদ্ধান্তের উপর রাখতে আদেশ করা হয়েছে। আয়াতের বাহ্যিকতা থেকে নির্ধারিত কোনো ক্ষেত্রে ‎অগ্রবর্তীতা কে নিষেধ করা হয়েছে বলে অনুমিত হয় না।

এই বাহ্যিকতা এই ইঙ্গিত করে যে, ‎প্রত্যেক জিনিষেই অগ্রবর্তীতা নিষিদ্ধ এবং আগ না বাড়ার আদেশটি ব্যপক। রাসূলের আগে আগে ‎হাঁটা, রাসূলের পূর্বে খাবার শুরু করা সবই এই আয়াতের আওতাভুক্ত। অবশ্য যদি রাসূল সা. ‎স্পষ্টকরে আগে বাড়ার অনুমতি দেন, তাহলে সুযোগ আছে।

এই আয়াত যেন এই পয়গাম দিচ্ছে ‎যে, রাসূলের পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করতে হবে, কুরআন-সুন্নাহকে নিজের ইজতিহাদ আর গবেষণার ‎উপরে রাখতে হবে এবং যে কোনো বিষয়ের সমাধান অনুসন্ধানে সর্বপ্রথম কুরআন-সুন্নাহরই ‎দ্বারস্থ হতে হবে।

মুআয ইবনু জাবাল রা. কে ইয়েমেনের বিচারক করে প্রেরণের সময় রাসূল সা. ‎তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কীভাবে সিদ্ধান্ত নিবে? উত্তরে তিনি বললেন, কুরআন অনুযায়ী।

‎রাসূল বললেন, যদি কুরআনে না পাও, তাহলে? মুআয রা. বললেন, রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ অনুযায়ী। ‎এবারে রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, যদি সুন্নাহতেও না পাও, তাহলে কী করে সিদ্ধান্ত নিবে? ‎উত্তরে মুআয রা. বললেন, আমি ইজতিহাদ করবো। উত্তর শুনে রাসূল সা. তার বুকে হাত রেখে ‎বললেন, কৃতজ্ঞতা সেই আল্লাহর, যিনি স্বীয় রাসূলের দূতকে সেই পদ্ধতির তাওফীক দিয়েছেন, যা ‎তাঁর রাসূল পছন্দ করেন। (সুনানু আবী দাউদ)‎

এই ঘটনায় মুআয রা. এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ এবং কুরআন-সুন্নাহকে সর্বাগ্রে রাখার প্রতি তার হিম্মত ‎ও পরিকল্পনার কথা পাওয়া যাচ্ছে।
উপরে বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলের সাথে স্বীয় নাম রাসূলের সম্মানার্থে উল্লেখ ‎করেছেন। এবং এটা বুঝিয়েছেন যে, কোনো কথা বা কাজে রাসূলের থেকে আগ বেড়ে যাওয়া ‎আল্লাহর সঙ্গে বে-আদবী করার সমতুল্য; কারণ রাসূলের কথা তো আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ীই ‎হয়ে থাকে। মোটকথা, সম্মান আর বড়ত্বের আবশ্যিক দাবীই হলো আল্লাহর রাসূল থেকে আগ ‎না বাড়া। বান্দার সৌভাগ্য আর সফলতার ভিত্তি এই আনুগত্য আর সম্মানপ্রদর্শনেরই উপর। ‎

৩. উঁচু আওয়াজে কথা বলার নিষেধাজ্ঞা। ‎কুরআনে বলা হয়েছে, “হে মু’মিনগণ, নবীর আওয়াজের উপর নিজের আওয়াজ কে উঁচু করিও ‎না। তোমরা যেমন উচ্চ আওয়াজে পরস্পর কথা বলো, নবীর সাথে তেমন উচ্চ আওয়াজে কথা ‎বোলো না। নচেত তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে, অথচ তোমরা টেরও পাবে না”। ‌‎(সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৩)‎

এই আয়াতে রাসূলের মাজলিসে আওয়াজ উঁচু করতে এবং রাসূলের সঙ্গে উচ্চ আওয়াজে কথা ‎বলতে নিষেধ করা হয়েছে; কারণ উচ্চ আওয়াজে কথা বলার মধ্যে তাঁর প্রতি অসম্মান এবং ‎অমর্যাদা প্রকাশ পায়। উচ্চ আওয়াজে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়ে রাসূলের প্রতি সম্মান ‎প্রদর্শনের গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‎

এই আয়াতে ভিন্ন আরেকটি বাস্তবতাও তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে সম্মানের সর্বোচ্চ ‎আসনে স্থান একমাত্র রাসূল সা. এর জন্য। তিনি ছাড়া অন্য কেউ যতই সম্মানিত হোক না কেন, ‎তাকে অসম্মান করলে ততটা শাস্তি আল্লাহ দিবেন না, যতটা শাস্তি দিবেন কুফরের কারণে। বেশি ‎থেকে বেশি, সেটাকে অসৌজন্যতা এবং অভদ্রতা সাব্যস্ত করা হবে।

পক্ষান্তরে রাসূল সা. এর ‎প্রতি মর্যাদা প্রদানে এবং তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সামান্য ত্রুটিও এত বড় অপরাধ যে, তা দ্বারা ‎মানুষের পুরো জীবনের উপার্জিত নেক আমল এবং সওয়াব সব বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ ‎রাসূল সা. এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন মূলত আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। আর রাসূল সা. এর ‎ব্যাপারে কোনো অসৌজন্যতা, আল্লাহর সঙ্গেই অসৌজন্যতার শামিল।

এর পরবর্তী আয়াতে ‎এটাও বলা দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলের সঙ্গে নিচু আওয়াজে কথা বলা, অন্তরে সুপ্ত থাকা ‎তাক্বওয়ার বাহ্যিক নিদর্শন। এটাই অন্তকরণের পবিত্রতার প্রমাণ। এ থেকে এটাও স্পষ্ট যে, ‎রাসূলের সম্মুখে উচ্চ আওয়াজে কথা বলা, অন্তরের অপরিচ্ছন্নতা এবং তাক্বওয়া শুন্যতার উন্মুক্ত ‎নিদর্শন। বর্ণিত আছে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর উমর রা. এত আস্তে কথা বলতেন, রাসূল ‎সা. দ্বিতীয়বার তাকে না জিজ্ঞেস করলে কী বলেছেন, বুঝতেই পারতেন না। ‎

ইমাম ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, “জীবিত অবস্থায় রাসূল সা. এর সম্মান ও ইহতিরাম যেমন ‎আবশ্যক ছিলো, ইন্তেকালের পরও ঠিক একইভাবে আবশ্যক। যখনই তাঁর কোনো হাদীস পাঠ ‎করা হবে, প্রত্যেক শ্রোতার জন্য আদব ও সম্মানের সাথে শোনা আবশ্যক। হাদীস পাঠের সময় ‎শ্রোতাদের উঁচু আওয়াজ করা এবং শোনার প্রতি মন না দেওয়া অন্যায়”। (ইবনুল আরাবী কৃত ‎আহকামুল কুরআন: ৪/১৭১৪)

ইবনু কাছীর রহ. লেখেন, “রাসূল সা. এর রওযার সামনেও উঁচু আওয়াজ করা নিষেধ। রাসূল সা. ‎স্বীয় কবরেও সম্মান পাওয়ার হক্বদার। রাসূল সা. এর মসজিদে উচ্চ আওয়াজে পরস্পর ‎আলোচনাকারী দুই ব্যক্তিকে উমর রা. এজন্যই কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন এবং তাদের কে ধমক ‎দিয়েছেন”। (তাফসীরু ইবনি কাছীর: ৪/২২২) ‎

মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী এই আয়াতের পয়গাম ও বাণী উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেন, ‌‎“আওয়াজ উঁচু করার কথা মানুষের অভ্যন্তর সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত সত্ত্বার মতো বলা ‎হয়েছে। যে ব্যক্তি নিজের আওয়াজ কে অন্যের আওয়াজের উপর উচ্চ রাখার চেষ্টা করে, তার এই ‎কাজ মূলত এই সাক্ষ্য প্রদান করে যে, সে নিজেকে শ্রোতা থেকে উপরের স্তরের জ্ঞান করে।

এই ‎ধারণা ও ভাবনা অন্যের থেকে উপকার গ্রহণের পথ একেবারেই রুদ্ধ করে দেয়। যদি রাসূলের ‎সাথে কোনো ব্যক্তি এই পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে সে তো কেবল রাসূল সা. থেকে উপকৃত ‎হওয়া থেকেই বঞ্চিতই হলো না। বরং আল্লাহর তাওফীক্ব থেকেও মাহরুম হয়ে গেলো; কারণ ‎রাসূল সা. তো আল্লাহর কথাই বলেন। আল্লাহর পথই দেখান”। (তাদাব্বুরে কুরআন: ৭/৪৮৯-‎৪৯০) ‎

৪. নির্জনে কথা বলার বাহানায় কষ্ট দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে মু’মিনগণ, তোমরা যখন রাসূল সা. এর সঙ্গে নির্জনে কথা বলতে ‎চাও, তখন নির্জনে কথা বলার পূর্বে কিছু সদক্বা দিবে। এটা তোমাদের জন্য উত্তম এবং ‎পবিত্রতর। যদি তোমরা সদক্বা দেওয়ার মতো কিছু না পাও, তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং ‎দয়ালু”। (সূরা মুজাদিলা, আয়াত: ১২) ‎

মুসলমানগণ সর্বদাই রাসূল সা. থেকে উপকৃত হতে আগ্রহী হয়ে অপেক্ষায় থাকতেন। সাধারণ ‎মজলিস ব্যতিতও অনেক মানুষ গোপনে নিভৃতে রাসূল সা. এর সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন। ‎রাসূল সা. সবাইকে সময়ও দিতেন।

কিন্তু রাসূল সা. এর জীবন তো অনেক বেশি ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ ‎ছিলো। তাই সবাইকে সময় দেওয়াও খুব কঠিন ছিলো। এ ছাড়া কিছু কিছু মুনাফিকও অনিষ্ট ‎করার জন্য রাসূল সা. এর সঙ্গে নির্জনে কথা বলতেন।

কিছু সাধারণ মুসলমানও গুরুত্বহীন বিষয়ে ‎রাসূল সা. এর সঙ্গে নির্জনে দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলতেন। রাসূল সা. তাদের কে নিজের সত্ত্বাগত ‎সৌজন্যতার দরুণ সময়ও দিতেন। কিন্তু এটা তাঁর জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আল্লাহ ‎তাআলা রাসূল সা. কে এই কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য প্রথম দিকে তাঁর সঙ্গে নির্জনে কথা বলার ‎পূর্বে তাঁর কাছে সদক্বা প্রদান করার আদেশ করেছেন। তাই এই বিধান আসার পর সর্বপ্রথম আলী ‎রা. এক দীনার সদক্বা দিয়ে রাসূল সা. এর সঙ্গে নির্জনে কথা বলেছেন।

কিন্তু এই বিধান অল্প ‎ক’দিন পরই রহিত হয়ে গিয়েছে। এই সূরার পরের আয়াতেই আল্লাহ তাআলা বলেন, “নির্জনে ‎কথা বলার পূর্বে সদক্বা দিতে কী তোমরা ভয় পেয়ে গেছো? যদি তোমরা সদক্বা দিতে না পারো -‎আর আল্লাহ তাআলাও তোমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন- তাহলে পাবন্দির সাথে নামায আদায় ‎করো। যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। আর তোমরা যা করো, ‎আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত। (সূরা মুজাদালা, আয়াত: ১৩) ‎

মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. লেখেন, “এই বিধান যদিও রহিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যেই কল্যাণের ‎স্বার্থে এই বিধান দেওয়া হয়েছে, সেটা অর্জিত হয়ে গিয়েছে। মুসলমানগণ নিজেদের অন্তরে থাকা ‎মুহাব্বাতের কারণে এই ধরণের নির্জন মজলিস দীর্ঘ করা থেকে বিরত হয়ে গেছে। আর ‎মুনাফিকরা সাধারণ মুসলমানদের কর্মধারার বিপরিত করতে গেলে তাদের নেফাক প্রকাশিত হয়ে ‎যাওয়ার আশংকায় বিরত হয়ে গিয়েছে”। (মাআরিফুল কুরআন: ৮/৩৪৮) ‎

নির্জনে কথা বলার পূর্বে সদক্বা প্রদানের বিধানের রহস্য বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম রাযী রহ. চারটি ‎রহস্য উল্লেখ করেছেন।

ক. এর মাধ্যমে রাসূল সা. এর সম্মান ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গে নির্জনে কথা বলার ‎গুরুত্ব প্রকাশ করা হয়েছে। মানুষ কষ্টের পর কিছু পেলে, গুরুত্বসহ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে সহজে ‎কিছু পেলে সেটাকে সাধারণ মনে করে। নির্জনে কথা বলার পূর্বে সদক্বা দিতে হলে, নির্জনে কথা ‎বলা কে গুরুত্ব দিবে। ‎

খ. এই সদক্বার মাধ্যমে দরীদ্রদের উপকার হবে। ‎গ. আখিরাতপ্রত্যাশী আর দুনিয়াপ্রত্যাশীদের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। যারা নির্জনে কথা ‎বলার পূর্বে সদক্বা প্রদান করলো, তারা প্রকারান্তরে আখিরাতের মুহাব্বাত আর দুনিয়ার তুচ্ছতা ‎প্রকাশ করলো। ‎

ঘ. এর দ্বারা রাসূল সা. এর আরাম আর শান্তি প্রতিষ্ঠা হলো। কষ্ট-ক্লেশ থেকে তাঁর পরিত্রান হলো। ‌‎(তাফসীরে কাবীর: ১৫/২৭২) ‎
মোটকথা, এই বিধানের মাধ্যমে রাসূল সা. এর সম্মান, মহত্ব আর বড়ত্ব বজায় রাখার সবক্ব ‎দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর সময়ের প্রতি যত্ন নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ‎

৫. নবীর পরিবার সম্পর্কীত নির্দেশনা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে মু’মিনগণ, নবীর ঘরে প্রবেশ করো না। অবশ্য তোমাদেরকে খাবারের ‎জন্য আসার অনুমতি দেওয়া হলে ভিন্ন কথা। তখন এভাবে আসবে যে, তোমরা তা প্রস্তুত হওয়ার ‎অপেক্ষায় বসে থাকবে না। বরং যখন তোমাদেরকে ডাকা হবে, তখন যাবে। তারপর যখন ‎তোমাদের খাওয়া হয়ে যাবে, তখন নিজে নিজে চলে যাবে, কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ে যাবে না। ‎কারণ, তোমাদের এই আচরণ নবী কে কষ্ট দেয়। কিন্তু তিনি (তোমাদেরকে তা বলতে) ‎সঙ্কোচবোধ করেন। আর আল্লাহ সত্য বলতে সঙ্কোচবোধ করেন না। নবীর স্ত্রীগণের কাছে ‎তোমরা কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।

এ পন্থা তোমাদের এবং তাদের অন্তরকে ‎অধিকতর পবিত্র রাখতে সহায়ক হবে। আল্লাহর রাসূল কে কষ্ট দেওয়া তোমাদের জন্য জায়েয ‎নেই। তাঁর (ইন্তেকালের) পরে কখনো তাঁর স্ত্রীদেরকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য জায়েয নেই। ‎আল্লাহর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ। তোমরা কোনো কিছু প্রকাশ করো বা গোপন করো, আল্লাহ ‎তো প্রতিটি বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। (সূরা আহযাব, আয়াত: ৫৩-৫৪)‎
এই আয়াতে মোট চারটি বিষয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ‎

ক. অনুমতি ব্যতিত মু’মিনদের কে রাসূল সা. রুমে এবং ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ‎এটাও স্পষ্ট করা হয়েছে যে, যারা রাসূল সা. এর ঘরে খাবারের জন্য দাওয়াত পায়, তারা যেন ‎খাবার প্রস্তুত হওয়ার পূর্বে ঘরে না যায়; কারণ এতে ঘরের মানুষ সংকীর্ণতায় নিপতিত হয়। বরং ‎খাবার প্রস্তুত হওয়ার পর যখন ডাকা হয়, তারা যেন তখনই যায়। ‎

খ. খাবার শেষ হওয়ার পর চলে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় আলাপ-আলোচনায় ‎লিপ্ত হয়ে রাসূল সা. কে কষ্ট দিতে নিষেধ করা হয়েছে। ‎

গ. রাসূল সা. এর স্ত্রীগণের সাথে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। পর্দার ‎এই বিধান সকল নারীদের ক্ষেত্রেই। এখানে শুধু নবীপত্নীগণের কথা বলা হয়েছে বিশেষ ‎প্রেক্ষাপটের প্রতি লক্ষ্য রেখে। ‎

ঘ. রাসূল সা. এর সম্মানিতা স্ত্রীগণের সাথে কোনো মুসলমানের জন্য কখনোই বিবাহ বৈধ না ‎হওয়ার মর্মে নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়েছে; কারণ তাঁরা তো মু’মিনদের মায়ের স্তরের। চিন্তা করলে ‎বুঝা যায়, এই সকল বিধান কেবল রাসূলের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে দেওয়া হয়েছে। ‎

নবীর প্রতি সম্মানের এই পাঁচটি নির্দেশনায় মূলত উম্মাতের প্রতিটি সদস্যকে সবসময় এবং সকল ‎পদ্ধতিতে রাসূল সা. এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাহাবিগণ এই আয়াত ‎এবং বিধানসমূহ অনুযায়ী আমল করে এবং রাসূল সা. এর সম্মানের হক্ব আদায় করে পুরো ‎উম্মাতের সামনে দৃষ্টান্ত প্রকাশ করে গেছেন।

উদাহরণস্বরুপ রাসূল সা. এর প্রতি সাহাবিদের ‎সম্মান প্রদর্শনের একটি ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে। সপ্তম হিজরীতে কুরাইশ যখন উরওয়া বিন ‎মাসউদকে হুদাইবিয়ার সন্ধির বিষয়ে রাসূল সা. এর সঙ্গে কথা বলতে পাঠালো। তখন সে ‎সাহাবিদের অন্তরে রাসূলের প্রতি সম্মানের যে অবাককর নমূনা দেখেছে, সেটার বর্ণনা দিতে গিয়ে ‎বলেছে, ‘মুহাম্মাদ যখন ওযু করে, তখন তাঁর ওযুর পানির উপর সঙ্গিগণ ঝাঁপিয়ে পড়তো। ‎মুহাম্মাদ থুথু নিক্ষেপ করলে, সাহাবিরা সেই থুথু হাতে নিয়ে চেহারা এবং শরীরে মাখিয়ে নিতো। ‎মুহাম্মাদের কোনো চুল পড়ে গেলে, তারা দ্রুত তা লুফে নিতো।

মুহাম্মাদ কোনো আদেশ করলে, ‎তারা তা বাস্তবায়নে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। যখন তিনি কথা বলেন, তখন তারা একেবারেই নিশ্চুপ ‎হয়ে থাকে। চোখ মেলে কেউ তাঁর দিকে তাকাতে পারতো না’।

এসব দেখে উরওয়া কুরাইশদের ‎কাছে ফিরে এসে বললো, শোনো কুরাইশ, আমি কিসরা, কায়সার এবং নাজাশীর দরবার দেখেছি, ‎আল্লাহর ক্বসম, আমি কোনো বাদশাহ কে তার প্রজাদের মধ্যে এতটা সম্মানিত আর মর্যাদাবান ‎পাইনি, মুহাম্মাদ সা. কে স্বীয় সঙ্গীদের মধ্যে যতোটা সম্মানিত আর মর্যাদাবান পেয়েছি। (সহীহুল ‎বুখারী) ‎

সাহাবিদের অন্তরে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা আর মর্যাদার যে অবস্থান ছিলো, এ ঘটনা ছিলো ‎সেটার একটা ঝলক মাত্র। এই জযবা আর আন্তরিকতা গ্রহণের জন্যই প্রত্যেক মুসলমান ‎নির্দেশিত। এটাই ঈমানী এবং কুরআনী দাবী। ‎

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ