আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মেছিলেন বাংলার রসিকরাজ সৈয়দ মুজতবা আলী। চলুন জেনে আসি তাঁর মজার জীবন থেকে 'অনেক মজার' দশটি ঘটনা।
এক- সৈয়দ মুজতবা আলী তখন বেশ বিখ্যাত লেখক। প্রতিদিনই তাঁর দর্শন লাভ করতে ভক্তরা বাসায় এসে হাজির হয়। একদিন এক ভক্ত মুজতবা আলীর কাছে জানতে চাইলেন, তিনি কোন বই কী অবস্থায় লিখেছেন। মুজতবা আলী যতই এড়িয়ে যেতে চান, ততই তিনি নাছোড়বান্দা।
শেষে মুজতবা আলী সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, 'দেখো, সুইস মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুসতাফ জাং একদা তাঁর ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন, কিছু লোক আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কীভাবে লিখি। এ ব্যাপারে আমাকে একটা কথা বলতেই হয়, কেউ চাইলে তাকে আমরা আমাদের সন্তানগুলো দেখাতে পারি, কিন্তু সন্তানগুলো উৎপাদনের পদ্ধতি দেখাতে পারি না।'
দুই- সৈয়দ মুজতবা আলীর সেন্স অব হিউমার ছিল ভয়াবহ। তেমনই একটা ঘটনা- জার্মানিতে এক জাহাজে চড়েছেন উনি। জাহাজে স্কুলের মেয়েদের একটি বনভোজন দলও যাচ্ছে। সোনালি চুল, নীল চোখের এক মিষ্টি মেয়ে বারবার মুজতবা আলীর দিকে তাকাচ্ছে। মুজতবা আলী বেশ বিব্রতবোধ করছেন। জাহাজ থামার আগে আগে মেয়েটি এসে মুজতবা আলীর পথ আগলে বলে, ‘আমাকে সত্যি কথা বলে যাবে হানি?’
ধক করে উঠল মুজতবা আলীর বুক। বললেন, ‘বলো ছোট্ট মেয়ে, কী জানতে চাও?’ মেয়েটি বলল, ‘তুমি চুলে কী রং লাগাও?’ হেসে মুজতবা বললেন, ‘আমার চুল ন্যাচারালিই কালো।’ মেয়ে বলে, 'মিথ্যুক! লুকাচ্ছ। যদি না বলো, আমি মিসকে বলে দেব যে তুমি আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করছিলে।'
কাঁপন ধরে গেল মুজতবার। বুদ্ধি আঁটলেন। চট করে শার্টের বোতাম খুলে বললেন, 'দেখো, আমার বুকের চুলও কালো। বুকের চুল কেউ কালার করে?' মেয়েটি এবার বিশ্বাস করল। অবাক হয়ে তাকিয়ে ‘ইউ আর সো বিউটিফুল’ বলে দৌড়ে উধাও হয়ে গেল।
তিন- মুজতবা আলীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক মোহম্মদ আবদুল ওয়ালী একবার কলকাতার নামকরা কলেজের প্রাণিবিদ্যার এক অধ্যাপককে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করাতে। অধ্যাপককে দেখে মুজতবা আলীর জিজ্ঞাসা, 'হঠাৎ এখানে এসে হাজির কেন?'
এমন জিজ্ঞাসায় অধ্যাপক একটু জড়সড়।
ডাক্তার জানান, 'পরিচিত হওয়ার আগ্রহে এসেছেন।'
আলী সাহেব বললেন, 'না! না! না! আসল মতলবটা হল এই চ্যাংড়া অধ্যাপকের রিসার্চ সেন্টারে জন্তু জানোয়ারের নিশ্চয় কিছু অভাব ঘটেছে। তাই আমাকে দেখতে এসেছে।'
চার- ঘটনাস্থল শান্তিনিকেতনের এক চায়ের দোকান। সেখানে উপস্থিত একজন ছাত্রী যিনি জার্মান ভাষা নিয়ে সদ্য পাশ করেছেন। আলী সাহেবও তখন জার্মান পড়াতেন। বিশ্বভারতীর কোনও অধ্যাপক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েটির সঙ্গে। তার পরেই আলী সাহেবের করাঘাত, 'ইস, আমি জার্মান পড়াতে এলুম আর সুন্দরী তুমি বেরিয়ে গেলে। আচ্ছা দেখি কী রকম জার্মান শিখেছ। একটা খিস্তি করো তো জার্মান ভাষায়। ভয় নেই, কেউ এখানে বুঝবে না (!)'
আলী সাহেব এ রকমই ছিলেন। শোনা যায়, জার্মান ভাষায় মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার সময়েও ছাত্রীদের এই রকমই কান লাল করা প্রশ্ন করতেন।
পাঁচ- দেশভাগের পর নিয়মের গ্যাড়াকলে পড়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে গাঁজা রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। গাঁজার রপ্তানি বন্ধ হতে হতে গুদামে জমে আছে সব গাঁজা। এদিকে থেমে নেই নতুন গাঁজা উৎপাদনও। বাধ্য হয়ে পুরাতন গাঁজা নষ্ট করে ফেলতে হবে। যেখানে গাঁজা পোড়ানো হবে সেখানকার দায়িত্বরত অফিসারের আত্মীয় ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী।
অফিসার আলী সাহেবকে বললেন, 'চল দেখবি।' যথাস্থানে গিয়ে দেখলেন গাঁজা পোড়ানোর জন্য হাজির হয়েছেন পুরো গ্রামবাসী। যেন কোনো উৎসব লেগেছে। আগুন লাগানোর পর বাতাস যেদিকে যায়, গ্রামবাসী (বৃদ্ধ, যুবক, শিশু) সে দিকে দৌড়ায়! মজার ব্যাপার হলো, মুজতবা আলীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না৷ পরদিন আর মনেই করতে পারেননি সেদিন রাতে কিভাবে তিনি বাড়ি ফিরেছেন, জিপে করে নাকি হাতির পিঠে করে...।
ছয়- একবার পুজোর ছুটিতে আলীসাহেবের সঙ্গে একদল ভক্ত কলকাতায় ফিরছেন। সঙ্গে সেই ব্যক্তিগত চিকিৎসক। স্টেশনে এসে জানা গেল, ট্রেন ৪৫ মিনিট দেরিতে চলছে। মুজতবা আলী প্রস্তাব দিলেন, রেস্তেরাঁয় গিয়ে সময় কাটানো যাক। কিন্তু খেতে খেতেই হঠাৎ ট্রেনের বাঁশির শব্দ। দলের কেউ বলে উঠেছিলেন, 'ওই বোধহয় ট্রেন এসেছে।'
খাওয়াদাওয়া ফেলে সকলে দ্রুত প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু স্টেশনে তখন ঢুকেছে মালগাড়ি। মুজতবা আলী জিজ্ঞেস করলেন, 'ডাক্তারি পরিভাষায় একে কী বলে?'
ডাক্তার উত্তর দিতে পারেননি। রসিক মুজতবা উত্তর দিয়েছিলেন, 'একেই বলে ফলস লেবার পেইন।'
সাত- মুজতবা আলীর প্রথম প্রকাশকের সঙ্গে ঝামেলা নিয়ে মামলা হয়। আইনজীবীর দরকার হয়ে পড়ে তাঁর। তিনি যান ব্যারিস্টার তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। মুজতবা আলী প্রথম সাক্ষাতেই বলেন, 'ভাই, আমি এমন একজন কৌশুলী চাই, যে আমার এই মামলাটায় আমায় হারিয়ে দেবে।'
তাপসকুমার ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। ফলে তাঁর হাজির-জবাব, 'আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। আমি এখনও পর্যন্ত একটা মামলাতেও জিতিনি!'
আট- সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা’র প্রকাশক ছিলেন সবিতেন্দ্রনাথ। সেটি ছিলো ভানুবাবুদের প্রকাশনা সংস্থা। বইয়ের জন্য চুক্তি হওয়ার পর আলী সাহেবের কথা মতো প্রকাশক দল বেঁধে গেলেন শান্তিনিকেতনে। আলী সাহেব তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর স্ত্রীকে ডাকতে শুরু করলেন, 'ও বৌ,বৌ, এসে দ্যাখো, আমার কলকাতার পাবলিশাররা এসেছে।'
স্ত্রী তো এমন সম্বোধনে অতিথিদের সামনে সংকুচিত। একটু কুণ্ঠিত ভাবে বললেন, 'কিছু মনে করবেন না, উনি বৌ বৌ করে এমন ডাকেন, যাঁরা আসেন তাঁরা এবং আমি সবাই লজ্জায় পড়ি।' সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।
নয়- বিশ্বভারতীতে পড়াশুনা করার সময় একবার রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে মুজতবা আলী ভুয়া নোটিশ দিলেন, “আজ ক্লাশ ছুটি”.... ব্যাস আর যায় কোথায়!
সবাই রবীন্দ্রনাথ ছুটি দিয়েছেন ভেবে গন্তব্যে রওনা দিতে শুরু করলো।
দশ- শান্তিনিকেতনের অন্যান্য দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীও একজন দর্শনীয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।’ একবার একটি দলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, 'শান্তিনিকেতনে এসেছো কী কী দেখতে? ক্ষিতিমোহনবাবুকে দেখেছ?'
ওরা বললো, 'দেখেছি।'
'নন্দলাল বসুকে?' —'হ্যা, দেখেছি।'
'হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে?'
'তাঁকেও দেখেছি।'
মুজতবা আলী সাথেসাথে উত্তর দিলেন, 'ও, বাঘ সিংহ সব দেখে, এখন বুঝি খট্টাশটাকে দেখতে এসেছো!'
-কেএল