বেলায়েত হুসাইন।।
যেভাবে মক্কা বিজয়ের সূচনা হিজরি ৬ষ্ঠ সন, আরব জাহানের পরিস্থিতি মুসলমানদের প্রায় অনুকূলে কিন্তু তখনও ইসলামের সর্বাধিক সম্মানিত ইবাদতস্থল পবিত্র কাবাগৃহ মক্কার কুরাইশদের দখলে, সেখানে মদিনার মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এদিকে রাসুল (সা.)-কে স্বপ্ন দেখানো হলো-তিনি সাহাবাদের নিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করছেন।
নবীগণের স্বপ্ন নিছক কোন স্বপ্ন নয়; বরং আল্লাহর ইশারা। তাই রাসুল (সা.) স্বপ্ন বাস্তবায়নে ৬ষ্ঠ হিজরির ১ লা জিলকদ মক্কাভিমুখে ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা: ৩৪৫)
চৌদ্দ শ মতান্তরে পনেরো শ সাহাবিকে নিয়ে মহনবী (সা.) ম্ক্কার উপকণ্ঠ হুদাইবিয়া নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করলেন। কিন্তু নানা আশঙ্কায় মক্কার মুশরিকরা পুরনো শত্রুদের হুদাইবিয়া থেকে আর সামনে অগ্রসর হতে দিলো না। পরে নানা নাটকীয়তা শেষে আল্লাহর রাসুল সেখান থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক ‘হুদাইবিয়া সন্ধি’র। বাহ্য দৃষ্টিতে সন্ধির শর্ত সমূহ মুশরিকদের অনুকূলে ছিল কিন্তু মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এটিকে মুসলমানদের জন্য ‘ফাতহুম মুবিন’ বা স্পষ্ট বিজয় আখ্যায়িত করেছেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, মূলত হুদাবিয়ার চুক্তিই মক্কা বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। সন্ধির শর্তাবলী গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এটি বাস্তবিক পক্ষেই মুসলমানদের বিরাট বিজয়-ই ছিলো। কেননা, এতোদিন কুরাইশরা মুসলমানদের অস্তিত্বই স্বীকার করত না। (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা: ৩৫৩)
সন্ধি যখন কাল হলো কুরাইশদের জন্য হুদাইবিয়ার সন্ধির অল্প কিছুদিন পরেই ইসলাম ব্যাপক হারে প্রসারিত হতে শুরু করে, সন্ধি করা হয় যেন মুসলমানরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে- এ উদ্দেশ্যে, কিন্তু উল্টো সন্ধির ফলাফল কুরাইশদের শঙ্কিত করে তোলে। এ পরিস্থিতিতে সন্ধি লংঘনে নানা ষড়যন্ত্র আঁটে তারা। অবশেষে মুসলমানদের সঙ্গে বনু খুযাআর মৈত্রিতা স্থাপন এবং এর ভিত্তিতে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তাদের অনেক লোককে হত্যার মাধ্যমে সন্ধি ভঙ্গ করে কুরাইশরা। অথচ দু পক্ষের সঙ্গেই অন্য যেকেউ মৈত্রী গড়তে করতে পারবে-শর্তে এও উল্লেখ ছিল।
মক্কা বিজয় এবং নবীজির ‘সাধারণ ক্ষমা’ এ ঘটনার পরে রাসুল সা. বনু খুযাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করাতে কুরাইশদের নিকট দূত মারফত খবর পাঠান কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে এবং সন্ধি বাতিলের ঘোষণা দেয় আর বলে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এরই প্রেক্ষিতে ৮ম হিজরির দশম রমজানে রাসুল সা. মক্কাভিমুখী রওনা হন, সঙ্গে ১০ হাজার মুজাহিদ সাহাবি। এখানেও নানা নাটকীয়তা শেষে কুরাইশদের ঘাড়ের ওপর এসে নিশ্বাস নিতে থাকেন, উদ্দেশ্য-মক্কা বিজয়। তিনি যথাসম্ভব রক্তপাত এড়িয়ে মক্কায় প্রবেশের কৌশল করছিলেন।
ঘোষণা করলেন, কুরাইশদের যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নিবে, নিজ নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখবে তারা নিরাপদ। এভাবে বলা যায় যে, মহানবী সা. বিনা রক্তপাতেই বিজয়ীরূপে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যুগযুগান্তে সবার মুখে আজও যা আলোচিত হয়ে আসছে, যেই কুরাইশরা মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে সামর্থের শেষ সময় পর্যন্ত অপচেষ্টা চালিয়েছিল তাদেরকে তিনি ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেন, তাও কখন-যখন তিনি মক্কার অধিপতি, ইচ্ছে হলে নিয়মানুযায়ী সবাইকে মৃত্যুদন্ডও দিতে পারতেন। আসলে আল্লাহর রাসুলগণ উত্তম চরিত্র নিয়েই দুনিয়ায় আগমন করেন, যেন উম্মত তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এর আগে একই কাজ করেছিলেন হজরত ইউসুফ (আ.)।
তাঁর ওপর ভাইদের অবিচার সত্ত্বেও তিনি যখন মিসরের সর্বোচ্চ আসনে আসীন তখন তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালুর চাইতে অধিক দয়ালু’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৯২)। তথ্যসূত্র: আর রহিকুল মাখতুম, সীরাতে মুস্তফা
-এটি