রফিকুল ইসলাম জসিম
মৌলভীবাজার থেকে:
মৌলভীবাজারের রাজনগরের এক ইমামের বাড়ির চারপাশ ঘিরে রেখেছে কাকেরা। চারদিকে শুধু কাকের কা-কা শব্দ। বাঁশ ঝাড়, গাছের ডাল, কিংবা বাড়ির চাল, সর্বত্র কাকের অবাধ বিচরণ। তাই লোকজন এলাকার নাম দিয়েছেন ‘কাকের বাড়ি’। সন্ধ্যার পরে পুরো বাড়িটাই কাকে কালো হয়ে যায়।
কথিত আছে যে, দীর্ঘ চল্লিশ বছর আগে এই বাড়িতে বসবাস করতেন এখলাস নামের একজন ইমাম। মোয়াজ্জিনকে মারতে গিয়ে ভুল বশত ইমামকে হত্যা করে ফেলে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। এরপর থেকে ইমামের বাড়িতে বাসা বেঁধেছে কাকেরা। ইমাম মারা যাওয়ার পর থেকেই কাকের বসবাস শুরু হওয়ায় স্থানীয়রা বিষয়টা ‘ইমামের শোক’ হিসেবেই দেখছেন।
সরেজমিনে ‘কাকের বাড়ি’ গিয়ে দেখা যায়, ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে সূর্যটা যখন ডুব দেয় পশ্চিম আকাশে। তখনই ঝাঁকে ঝাঁকে কাক ফিরতে থাকে। এক এক করে গাছে গাছে বসে পড়ে কাকেরা। এ যেন কাকেদের এক স্বর্গরাজ্য! কা-কা শব্দে ভরে উঠে পুরো এলাকা। এতে খুশি এলাকার লোকজনও। জেলা শহর থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় আড়ালেই রয়ে গেছে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মেদেনিমহল গ্রামটি।
গ্রামের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের গ্রামের একটি বাড়িতে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কাক পাখি বসবাস করে। অনেক পাখি দেখে আমার এলাকার মানুষ আনন্দিত। এলাকার মানুষ বাড়ির নামটি দিয়েছে কাকের বাড়ি। একটি সিজনে এখানে অনেক পাখি আসে। সরকারের কাছে অনুরোধ করছি এগুলো সংরক্ষণ করার জন্য।
মো. শরিফ উদ্দিন বলেন, আমাদের মেদিনিমহল গ্রামের মৌলভীচক এলাকার কয়েকটি বাড়িতে দীর্ঘদিন কাক বসবাস করে। কাকগুলো কোনোদিন কারো ক্ষতি করেনি। আমরাও দেখে অনেক উপভোগ করি, আনন্দ পাই। আমাদের গ্রামেও বিভিন্ন সময়ে অনেক ধরণের পাখি আসে। অতিথি পাখিরা এখানে আসে আবার সময় হলে চলে যায়।
মসজিদের ইমাম আবু তোরাব বলেন, এই ‘কাকের বাড়ি’ আমাদের এলাকার সৌন্দর্য। পাখিগুলো দেখে দর্শকদের মনের মধ্যে আনন্দ জাগে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই পরিবেশ যদি আমরা ধরে রাখতে পারি তবে আমাদের মনের আনন্দ প্রেরণা ও উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে।
আল-কুরআন ও তাওরাতে কাকের বুদ্ধি প্রসঙ্গ জানা যায়, পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ) এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিল। তাওরাতের জেনেসিস অধ্যায়ে এসেছে, হাবিল ও কাবিলের মধ্যে কাবিল ছিল হিংসুক প্রকৃতির। হিংসার বশীভূত হয়ে সে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে।
কাবিল হাবিলকে হত্যা করলে আল্লাহ তা’য়ালা একটি কাক প্রেরণ করলেন তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। কাক তাকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে দাফন করতে হয়। আল্লাহ তা’য়ালা সূরা মায়েদার ২৭ থেকে ৩১ আয়াতগুলোতে এই ঘটনা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। বাংলায় অর্থ " অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের লাশ কিভাবে গোপন করবে তা তাকে দেখানোর লক্ষ্যে মাটি খনন করতে লাগল। (এটা দেখে)সে বলে উঠল, হায় আফসোস! আমি কি এই কাকটির মতো হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি! এভাবে পরিশেষে সে অনুতপ্ত হলো।
পরিবেশকর্মী ফুয়াদ আমেদ মুরাদ বলেন, একসময় সাইবেরিয়া থেকেও আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা আসতো। কিন্তু এখন আর আগের মতন পাখিরা আসে না। পাখি শিকার, বৃক্ষ নিধন এর আন্তরায়। পাখিরা সাধারণত গাছে, ডাল পালায় ও লতাপাতায় বসে। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে পাখিরা আজ বিলুপ্তির দিকে। কিছুসংখ্যক তরুণরা প্রতিনিয়ত বৃক্ষরোপন করে যাচ্ছে। এভাবে সকলে যদি বৃক্ষরোপণে এগিয়ে আসে তাহলে শুধু মেদেনিমহল কেন, পুরো বাংলাদেশ পাখিদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. রেজাউল ইসলাম রেজা বলেন, ‘হাজার হাজার কাক পাখি এখানে বসবাস করে। আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এখানে প্রতিনিয়তই কাক বসে। এগুলো নিয়েই আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার। আমি কাক পাখি, বক পাখিসহ আমাদের এলাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে সবাইকে মেদিনিমহল গ্রামে স্বাগত জানাই।
-এটি