আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: করোনা মহামারিতে অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছে দেশের বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও)। সিডর-আইলার মতো ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দুর্যোগে সক্রিয়ভাবে মাঠে দেখা গেলেও এবারের এই মহামারিতে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
ব্র্যাকসহ কয়েকটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কাউকে অসহায়-পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। উলটো কোনো কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে এই দুঃসময়ে সরকারের বিধিনিষেধ অমান্য করে ঋণের কিস্তি আদায়, গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া, জালিয়াতি, দুর্নীতি, অনিয়মসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি তিনি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের এক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকারের সমালোচনায় মুখর এনজিও ব্যক্তিত্বদের করোনার এই দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের পাশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ড. হাছান মাহমুদ আরও বলেন, অনেক এনজিও দশজনকে কিছু দিয়ে ছবি তুলে সবাইকে দেখায়, বিদেশে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছেও পাঠায়। আর তাদের কেউ কেউ টকশোতে সরকারের সমালোচনাই করে।
এদের মানুষের পাশে খুঁজে পাওয়া যায় না। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত এনজিও ২৫৩০টি। এদের মধ্যে দেশীয় অর্থায়নে পরিচালিত হয় ২ হাজার ২১৮টি, আর বিদেশি অর্থে চলে ৩১২টি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মৌলিক অধিকার, স্যানিটেশন, আর্সেনিক, এইডস/এইচআইভি, নারী, শিশু, শ্রমিক, মানবাধিকার, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা খাতে এই এনজিওগুলো কাজ করে থাকে।
তবে তাদের সবচাইতে অগ্রাধিকার খাতটি হলো ক্ষুদ্রঋণ। কমবেশি সবারই এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। এ দেশে এমনও এনজিও আছে যার কার্যক্রম ও শাখা-প্রশাখা পৃথিবীর প্রায় ১৫০টি দেশে বিস্তৃত। আবার এমন এনজিও আছে যার ললাটে নোবেল পুরস্কারের ছোঁয়া লেগে আছে। কারও কারও যেমন রয়েছে সফলতা। আবার দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক এনজিওর কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধও হচ্ছে।
জানতে চাইলে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কেএম তারিকুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘এনজিওগুলোর বেশির ভাগ প্রকল্প রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক। তারা রোহিঙ্গা নিয়েই বেশি ভাবে। কারণ বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায় এই খাতে কাজ করলে। আর এ কারণেই হয়তো করোনাকালীন দুঃসময়ে যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে দুস্থ এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল এনজিওগুলোর, আমরা তা দেখিনি।
এক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগও খুবই কম। দেশের মানুষের প্রতি মায়াটা তাদের কম কিনা, কে জানে?’ তিনি বলেন, ‘আমি উদ্যোগ নিয়েছি, চেষ্টা করছি-এনজিওগুলো যাতে করোনাকালীন এই দুঃসময়ে চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। কারণ এই দুটি বিষয় এখন এই মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন।’ কেএম তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক এনজিও জনসচেতনতা তৈরির নামে আলোচনা সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, উঠোন বৈঠক, প্রচারপত্র বিলি-এসবে বেশি আগ্রহী।
আমরা মনে করি প্রথম থেকেই এ কাজটি সরকার করে আসছে। এনজিওগুলো সত্যিকার অর্থে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাইলে চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে দাঁড়াতে হবে, এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী লাভবান হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে এনজিও কার্যক্রম শুরু হয় ত্রাণ সহায়তার মাধ্যমে। গত প্রায় ৫০ বছরে এ সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখে গিয়ে পৌঁছেছে। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সমাজসেবা অধিদপ্তরে, সমবায় অধিদপ্তরের অধীনে এবং মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে নিবন্ধিত হয়ে বাকি এনজিওগুলো কাজ করে আসছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন এনজিওগুলো ‘স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১’ আইনে নিবন্ধিত।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের এনজিওগুলোও তাই। কিন্তু সমবায় অধিদপ্তরের অধীন এনজিওগুলো চলে ‘দ্য কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট ২০০১’ আইন অনুসারে। আবার কিছু এনজিও আছে যারা যৌথ মূলধনী ও ফার্মগুলোর অধিদপ্তরের অধীন। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় ‘দ্য সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৮৬০’ অনুযায়ী। আর এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো চলে ‘দ্য ফরেন ডোনেশন (ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজ) অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮’ এবং ‘দ্য ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২’-এর অধীনে। তবে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অধীন এনজিওগুলো ‘মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি আইন ২০০৬’ অনুযায়ী চলে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে নিবন্ধিত হয়ে নানান নামে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এনজিওগুলোর বেশির ভাগই ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে টিকে আছে। এরা মূলত দেশীয় উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ঢিমেতালে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
আরেকটি অংশ দাতাদের আর্থিক সহায়তা ও অনুদানের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়ে আসছে। এরা সাধারণত ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দুর্যোগে এরাই সাধারণ-অসহায় মানুষ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে এসে দাঁড়ায়।
তবে গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাস দেখা দেওয়ার পর থেকে দীর্ঘ ১৬ মাসে হাতেগোনা কয়েকটি এনজিও বাদে বাকিদের দেখা যায়নি এই বিপন্ন সময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে। তারা সবাই অনেকটাই হাত গুটিয়ে বসে আছে।
জানা গেছে, বড় এনজিও হিসাবে পরিচিত ব্র্যাক করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পরপরই দেশে নিজস্ব উদ্যোগ ও অর্থায়নে রোগীদের পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। তাদের এই উদ্যোগ এখনো অব্যাহত রয়েছে। ব্র্যাকের মতো দেশে বড় বড় আরও অনেক পরিচিত এনজিও রয়েছে, যাদের সেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উলটো স্রোতে চলার অভিযোগ উঠেছে অনেক এনজিওর বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে জোরপূর্বক ঋণের কিস্তি আদায় করায় ঢাকা আহছানিয়া মিশন পরিচালিত ডাম ফাউন্ডেশন ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টকে (ডিএফইডি) জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
জালিয়াতি, দুর্নীতি, অনিয়মসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকায় গত ২৬ জুলাই বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘এনজিও কনসোর্টিয়াম’র নিবন্ধন বাতিল করে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। এ রকম আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে করোনাকালীন সময়ে। ফলে এনজিওগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এবং ভাবমূর্তিও বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
-এটি