মোস্তফা ওয়াদুদ
নিউজরুম এডিটর
কোরআনের সুর বিশ্বের সকল সুরের সর্বশ্রেষ্ঠ সুর। যে সুরে হৃদয় শীতল হয়। অন্তরে আসে প্রশান্তি। মুগ্ধ করে তোলে তনুমন। পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন এমনই এক কিতাব। যার বিরোধিতা করতে এসে ঈমান লাভ করেছে অসংখ্য মানুষ। কোরআনের ভুল ধরতে গবেষণা করতে এসে ঈমানের আলোয় আলোকিত করেছে নিজের হৃদয়। কত মানুষ কোরআনের সুরে মোহিত হয়েছে। সুরের মোহনায় হারিয়ে গিয়েছে। তার ইয়ত্তা নেই।
পৃথিবীর বুকে মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে কোরআনুল কারিম। কোরআন তেলাওয়াত শোনার মানে হলো শ্রেষ্ঠ বাণী শোনা। কোরআন হচ্ছে কাওসারের পানির মতো স্বচ্ছ ঝর্নাধারা। কোরআনে কারিমের তেলাওয়াত আলাদা ইবাদত বিশেষ। তবে কোরআন তেলাওয়াতই উম্মতের জন্য চূড়ান্ত লক্ষ্য নয় বরং তেলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সে অনুযায়ী আমল করা। কারি হিসেবে খ্যাতি লাভ করার উদ্দেশ্যে কোরআন তেলাওয়াত করা ঠিক নয়। দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যেও কোরআন তেলাওয়াত নয়। এমন তেলাওয়াতে কোনোরকম কল্যাণ নেই। কোরআন তেলাওয়াতের শিষ্টতাপূর্ণ কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। এগুলোর কোনোটা বাহ্যিক আবার কোনো কোনোটা অভ্যন্তরীণ।
তেলাওয়াতের সব শর্ত অক্ষুন্ন রেখে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছেন অনেকেই। তবে কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছেন, এমন বিশ্বখ্যাত পাঁচজন কারীকে নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন।
শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইস: শায়খ আবদুর রহমান বিন আবদুল আযিয বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আস সুদাইস। তিনি মক্কার মসজিদে হারামের প্রধান ইমাম ও খতিব। সৌদি আরবের রাজধানী বিয়াদে ১৩৮২ হিজরি সালে জন্মগ্রহণকারী সুদাইস ১৯৯৫ উম্মুল ক্বুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামি শরিয়া বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
শায়খ আবদুর রহমান বিন আবদুল আযিয বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আস সুদাইস ২০০৫ সালে বছরের সেরা ইসলামিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বছরও তিনি (the ‘Islamic Personality Of the Year’) এর সেরা ২০ জনের ভেতরে একজন নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগের ব্যবস্থা করেছেন।
মুহাম্মদ সিদ্দিক আল মিনশাবি: মুহাম্মদ সিদ্দিক আল মিনশাবি আজ থেকে প্রায় একশ’ বছর আগে ১৯১৯ মতান্তরে ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি মহান এই মনীষী মিসরের রাজধানী কায়রোর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সাওহাজ জেলার অন্তর্গত মিনশাহ এলাকার বাওয়ারেক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৮ বছর বয়সেই পবিত্র কুরআনুল কারীমের হিফজ সম্পন্ন করেন। কোরআন তেলাওয়াতে সুমিষ্ট সুরের কারণে বিশ্বে বিশেষ খ্যাতি রয়েছে এই কারীর। তিনি ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তেলাওয়াতের মাধ্যমে লক্ষ মানুষের অন্তরে স্থান করে নেওয়া কুরআনের এক মহান খাদেম তিনি।
হিফজ সমাপ্ত করে উলুমুল কুরআন বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য কারি মিনশাবি কায়রোর আল-আজহারে গমন করেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো বলে তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত দুই আলেম- শায়েখ মুহাম্মদ আবুল আলা এবং শায়েখ মুহাম্মদ সায়ুদীকে উস্তাদ হিসেবে পেয়ে যান এবং উভয়ের সান্নিধ্যে থেকে উলুমুল কোরআনে পান্ডিত্য অর্জন করেন। অল্পদিনেই কারি সিদ্দিক আল-মিনশাবির সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। যদিও নাম-যশ-খ্যাতির কোন লোভ ছিলো না ক্বারী সাহেবের বরং নিভৃতে কোরআনের খেদমত করে জীবন পার করে দেয়াই ছিলো তার আমৃত্যু ভাবনা।
কারী আবদুল বাসেত: শায়খ আবদুল বাসেত বিন মুহাম্মদ বিন আবদুস সামাদ বিন সালিম। মিসরের দক্ষিণে অবস্থিত ক্বিনা জেলায় ১৯২৭ সালে জন্ম নেওয়া এই কারী বিশ্বে একজন খ্যাতিমান কারী হিসেবে পরিচিত। এ বরেণ্য কারী ৩০ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্ববাসীর সামনে কোরআন তেলাওয়াতকে তিনি ভিন্ন ধারায় উপস্থাপন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
কারি আবদুল বাসিত আব্দ উস-সামাদ কারী আব্দুল বাসেত নামে পরিচিত। তিনি ১৯৭০ এর দশকের প্রথম দিকে তিনটি বিশ্ব কিরাআত প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন। আবদুস-সামাদ ছিলেন প্রথম হাফেজ, যিনি তার কুরআন পাঠ্যক্রমের বাণিজ্যিক রেকর্ডিং করেন, এবং মিশরের কারী পরিষদের প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি।
কারি আবদুল বাসিত মিশরের বাইরে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তানের লাহোরে বাদশাহী মসজিদ, সেইসাথে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত সবচেয়ে বড় মাদরাসা আল-জমিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারীও ভ্রমণ করেন। ১৯৬৪ অথবা ১৯৬৫ সালে জাকার্তা পরিদর্শন করেন ও সেই দেশের বৃহত্তম মসজিদে কুরআন পাঠ করেন।
কারী মাহির আল মুআইক্বিলি: মাহির হামদ মুআইক্বিল আল মুআইক্বিলি। তিনি হাফস বিন আছিমের অনুকরণে কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন। সৌদি আরবের মক্কায় ১৩৮৮ হিজরি সালে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত এই ক্বারী ১৪২৯ হিজরি সাল থেকে মসজিদে হারামে ইমামতির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনি উম্মুল ক্বুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল-এর ফিকহের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
শায়খ মিশারি আল আফাসি: মিশারি বিন রাশিদ বিন গারিব বিন মুহাম্মদ বিন রাশিদ আল আফাসি আল মুতায়ারি। তিনি একাধারে কারী ও একজন মুনশিদ বা নাশিদ শিল্পী। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বের মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাফসির বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছেন তিনি। তিনি কারী আল আফাসী নামে বেশি পরিচিত। তিনি ২০১২ সালে শ্রোতাদের ভোটে About.com এ শ্রেষ্ঠ কোরআন তিলাওয়াতকারীর সম্মানে ভূষিত হন।
বর্তমানে তিনি কুয়েতের রাষ্ট্রীয় মসজিদে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোরআনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধান কারী হিসেবে তেলাওয়াত বরেন। নুরা, আল-জাযি, আওরাদ নামে তার তিন মেয়ে ও রশিদ, মুহাম্মদ নামে তার দুই ছেলে রয়েছে।
এমডব্লিউ/