।।শাহনূর শাহীন।।
নেতা বা নেতৃত্ব সামাজিক পরিবর্তনে ব্যাপক ভুমিকা রাখে। হোক সেটা ব্যক্তি জীবনে কিংবা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে। নেতৃত্বের প্রভাব সব সময়েই অধিনস্ত বলয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
সমাজে যারা নেতৃত্ব পর্যায়ের থাকেন সরাসরি স্ব-শরীরে অংশ না নিলেও যদি ঐ কাজের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন তখন সাধারণ মানুষ স্বতস্ফূর্ততার সহিত তাতে অংশ নেয়। কখনো কখনো কারো নিরব সম্মতিই হয়ে উঠে বিজয়ের অস্ত্র।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেন তার নিজ নেতৃত্বগুনে। তার নেতৃত্ব এতোটাই প্রভাবশালী ছিলো যে, সে সময় তিনি যেই নির্দেশনা দিতেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মানুষ সেটা পালনে ছিলো বদ্ধ পরিকর।
কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক-ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, সামরিক-বেসামরিক, মুসলিম, হিন্দু জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্ব শ্রেণির মানুষের উপর তার প্রভাব ছিলো অতুলনীয়।
এক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি একাই লড়াই করেননি দেশের জন্য। নিজে লড়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন গোটা জাতিকে। লক্ষ লক্ষ প্রাণ আর মা বোনদের ইজ্জত ভুলন্ঠিত হওয়ার পরই এসেছে স্বাধীনতার সোনালি সূর্য।
১৯৭১ সালে লাল সবুজের একটি পতাকার জন্য লড়াই করেছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। অবদান রেখেছেন বিভিন্নজন বিভিন্ন দিক থেকে। কেউ লিখেছেন, কেউ গেয়েছেন, কেউ অংশ নিয়েছেন সম্মুখ সমরে।
কেউ আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, কেউ পথ দেখিয়েছেন বিজয়ের, কেউ এনে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় তথ্য, কেউ নিরবে প্রেরণা যুগিয়েছেন মুক্তিসেনাদের।
কেউ আবার দেশভাগের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত বিরুদ্ধবাদীদের সামনে প্রম্ন তুলেছেন মজলুম মানবতার পক্ষে, মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।
এমনই একজন অগ্রজ বীর মাওলানা আতাউর রহমান খান। ক্ষণজন্মা এ আলেম ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৮ সালের ৩১ জুলাই ঢাকায় আসার পথে হৃদরোগে আক্রন্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন।
তৎকালীন সময়ে মাওলানা আতাউর রহমান খান ছিলেন নেজামে ইসলাম পার্টির একজন সক্রিয় নেতা। অপরদিকে নেজামে ইসলাম পার্টি ছিলো রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিরুদ্ধ অবস্থানে।
নেজামে ইসলাম পার্টি দেশভাগের বিরোধীতা করতেন এই জন্য যে তারা মনে করতো পাকিস্তান থেকে দেশ ভাগ হলেও সেটা ভারতের অধীনস্ত হয়ে যাবে সুতরাং পরাধীন হওয়ার চেয়ে জালিমের অধীনে থাকাই ভালো।
নেজামে ইসলাম পার্টি দেশভাগের বিরুধী থাকলেও তাদের অবস্থান মানবতার বিপক্ষে ছিলো না। পাকিস্তান সরকারকে জালিম সরকার স্বীকারোক্তি সেটারই প্রমাণ বহন করে।
বাস্তবেও পাকিস্তানিদের জ্বালাও পোড়াও, জুলুম-নির্যাতন ও নারী নিপিড়ন দেখে তা সমর্থন করেননি নেজামে ইসলামের কোনো নেতাই। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তারা বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেনি।
মাওলানা আতাউর রহমান খান পাকিস্তানিদের বর্বরতা দেখে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। সমর্থন তো করেনইনি বরং নিজ দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের পক্ষে তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। দল থেকে পদত্যাগও করেন মাওলানা খান।
মাওলানা খান হানাদার বাহিনীর বিভৎসতা দেখে দলের প্রধান ও তার রাজনৈতি গুরু মাওলানা আতাহার আলীকে পদত্যাগের আলটিমেটাম দিয়ে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি ছয়টি বিষয়ে উত্থাপন করে তার তার সন্তোষজনক জবাব এবং সমাধান না পেলে দলত্যাগ এবং বাংলাদেশের পক্ষে থাকার ঘোষণা দেন।
চিঠিতে তিনি লিখেন, (চিঠিটি হুবুহু উল্লেখ্য করা হলো।)
আমারা নানা কারণে বর্তমান টানাপোড়েনের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছি এবং পাকিস্তানরে অস্তিস্ত টিকিয়ে রাখতে বৈধ সকল কাজ কতে প্রস্তত আছি এবং করছি। কিন্তু বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা উপস্থাপন করতে চাই।
যেহেতু আমার আল্লাহর ফজলে আলেম, কাজেই ইলমের আলোকে সবকিছু যাচাই না করে অন্ধের মতো কিছু করতে আমার প্রস্তুত নই। ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই নিজ নিজ কর্ম সম্পর্কে দায়ী; তদুপরি আলেম সমাজকে কুলুষিত হতে না দেয়াও আমাদের দায়িত্ব।
পাকিস্তানিদের টার্গেট থেকে বাঁচতে যুদ্ধের পুরো ন’মাস মাওলান খান বাসার সামনে ব্যাংকার তৈরি করে আশ্রয় নিতেন। আশ্রয় দিতেন অন্যেদেরও। অনেক হিন্দু পরিবারকেও তিনি আশ্রয় দিয়ে জীবন রক্ষায় সহযোগিতা করেছিলেন
পাক বাহিনী দেশে যা করতেছে ইসলামের দৃষ্টিতে এর পর্যবেক্ষণ করে আমি ছয়টি বিষয়কে না-জায়েজ বলে চিহ্নিত করেছি। এই ছয়টি বিষয় সংশোধন করা ব্যতীত তাদরে সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা কোনোভাবেই জায়েজ হবে না।
যেভাবেই হোক এই ছয়টি বিষয় সংশোধন করা হোক। অন্যথায় আমি সবকিছু থেকে আলাদা থাকবো। আমাকে যেন কোনো কাজে বাধ্য করা না হয়।
ছয়টি বিষয় নিম্নরুপ:
১.একটি ভুখন্ডের নামই পাকিস্তান নয়, বরং একটি আদর্শিক রাষ্ট্রের নাম পাকিস্তান। আদর্শিক রাষ্ট্রের হেফাজত ওই আদর্শের যথাযত হেফাজতে মাধ্যমেই হতে পারে।
অতএব দেশটির আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির হেফাজতের লক্ষ্যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া হোক। এটাকে কেবল মাত্র ভবিষ্যতের ওয়াদার উপর ছেড়ে দিলে চলবে না।
২. পাকিস্তান বিরোধদের দমন করার ক্সেত্রে শরিয়তের বিধানের পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। নির্ভুল , সঠিক, নিশ্চিত তথ্য না নিয়ে কাউকে রাষ্ট্রের শত্রু সাব্যস্ত করা যাবেন না।
কেউ শত্রু বলে চিহ্নিত হলে তার সঙ্গে ওই আচরণই করতে হবে যার সে যোগ্য। একজনের দোষে আরেকজনকে শাস্তি দেয়া যাবে না। যথা পিতার অপরাধে সন্তান বা ভাইয়ের অপরাধে ভাইকে।
৩. এ ভুখন্ডের সকল সম্পদ আমাদের জাতীয় সম্পদ। এসববের ব্যাপক ধ্বংসসাধন আমাদের জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করার নামান্তর। অতএব দেশ রক্ষোর নামে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা যাবে না।
৪. ব্যক্তির অপরাধে তার সহায়-সম্পদ, বাড়িঘর, সামানপত্র, দোকানপাট, ফল-ফসল ধ্বংষ করা যাবে না। কারণ এগুলো তার উত্তরাধীকারীদের সম্পদ।
উত্তরাধীকারীদের সহায়-সম্বলহীন করে দেয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। একজনের বাড়িতে আগুন দিতে গিয়ে সাড়া গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে; এটা কোন ধরনের জুলুম?
৫. লুটপাট বন্ধ করতে হবে। লুট করা ও লুটের সুযোগ করে দেয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম।
৬. নারীদের উপর জুলুম বন্ধ করা হোক শিশু, নারী ও বৃদ্ধদেরকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজত করতে হবে। তাদের উপর হাত উঠানো বন্ধ করতে হবে। নারীদের মা ও বোন গণ্য করতে হবে।
আশা করি উক্ত ছয়টি বিষয়ের উপর কঠোর আমল করা হবে।
হে আল্লাহ আমার মনের অবস্থার খবর তুমিই রাখো। সকল খারবি হতে আমাকে মুক্ত বাঁচাও। আমি কি করতে পারি, কে শুনবে আমার কথা? হে আল্লাহ, আমাদেরকে হেফাজত করো। তুমিই শ্রেষ্ঠ হেফজতকারী। আমাদেরকে জালেমদের হাত থেকে মুক্তি দাও।
আতাউর রহমান খান
১৬/০৮/১৯৭১
সূত্র- ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ পৃষ্ঠা ৩৭৪-৭৫ৎ
-কেএল