মোস্তফা ওয়াদুদ
নিউজরুম এডিটর
কুরআনের পাখি শায়খ নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক রহ.। একজন কুরআন প্রেমিক কারী। উড়ে বেড়ানো কুরআনের পাখি। পাখি যেমন উড়ে উড়ে জানান দেয় তার উপস্থিতি। ঠিক তেমনি শায়খ নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকও বিশ্বব্যাপী জানান দিয়েছেন তার হৃদয়গ্রাহী তেলাওয়াতের সুর দিয়ে। তিনি কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন হৃদয় দিয়ে। কুরআনের প্রতিটি আয়াত পড়তেন অন্তরের গভীর থেকে। আর কুরআনকে ধারণ করতেন হৃদয়ের কলিজা দিয়ে।
তাই তো তিনি যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন চোখ দিয়ে অশ্রুধারা ঝড়ে পড়তো। চোখের অশ্রুতে ভিজে যেতো মুখের দাড়ি। হৃদয় বেয়ে কান্না আসতো। তার তেলাওয়াতে মুগ্ধ করতো বিশ্ববাসীকে। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন তার সুমধুর ভঙ্গির তেলাওয়াত।
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর অঞ্চলের সুদান দেশের বাসিন্দা ছিলেন শায়খ নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক। সেদেশের আঞ্চলিকতা হিসেবে শায়খ নূরাইনের গায়ের রং কালো হলেও তার তেলাওয়াতে যেন মুক্তা ঝরতো।
বিখ্যাত এ সুদানী কারী ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ইউটিউবে তিনি বেশ জনপ্রিয়। তার তেলাওয়াতকৃত ভিডিওগুলো এ পর্যন্ত ইউটিউবে কয়েকশ মিলিয়ন ভিউ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইউটিউবের টপ টেন ভিউ কারীদের তালিকায় সেরা দশে স্থান করে নিয়েছে তার অবস্থান।
[caption id="" align="aligncenter" width="452"] জাফরান মিশিয়ে কাঠের কলম দিয়ে কাগজে লিখছেন শায়খ নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক। ছবি: উইকিপিডিয়া[/caption]
মরহুম কারী নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক রহ. শুধু একজন কারীই ছিলেন না। বরং সুদানের রাজধানী খার্তুমের বিখ্যাত মসজিদের খতিবও ছিলেন তিনি। যদিও কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী তাকে চিনে। কিন্তু এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় আর্টিস্ট। কাঠের কঞ্চিতে জাফরান মিশিয়ে তিনি রচনা করতেন মর্সিয়াগাঁথা। সুদানি ভাষায় রচিত এসব মর্সিয়া বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মৃত্যুর পর যে সকল কারী জনপ্রিয়তার কাতারে স্থান করে নিয়েছেন, কারী নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক রহ. তাদের অন্যতম।
কারী নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক রহ. ১৯৮২ সালে সুদানের কর্ডোফান রাজ্যের বারা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে নব্বই শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর সুদানের কর্ডোফান রাজ্যের বারা অঞ্চলের কাতায়েবের শাইখদের হাতে কুরআনুল কারিম মুখস্থ করেন। বিভিন্ন কিরাতে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য অন্যান্য সুদানী তেলাওয়াতকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন বিখ্যাত। একাধিক কেরাতে কোরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী ছিলেন তিনি। সুদানের পক্ষে তিনি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে। যেখানে তিনি ৮৩টি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোরআন তেলাওয়াতে তৃতীয় আন্তর্জাতিক পুরষ্কার লাভ করেন। কোরআনে কারিমের মধুর তেলাওয়াত শুনিয়ে শায়খ নুরাইন কোটি কোটি মানুষের আত্মার গভীরে ঠাঁই করে নিয়েছেন। তার কণ্ঠের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছেন সবাই।
তার সুমধুর কণ্ঠে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত হাজার হাজার রোজাদার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শ্রবন করতেন। বিশেষ করে রমজান মাসের তারাবির তেলাওয়াত রোজাদারদের কাছে বেশ আকর্ষণের বস্তু হয়ে উঠতো। কুরআনে কারিমের মর্ম অনুধাবন করে তার অসাধারণ তেলাওয়াত তাকে রাজধানী খার্তুমের সবচেয়ে বিখ্যাত মসজিদের ইমামের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।
ভক্তকূল অনুসারীগণ তার তেলাওয়াত শুধুই নিজেরাই শুনতেন না। তারা তেলাওয়াত চালু রাখেন নিজেদের ঘরে ঘরে। এমনকি রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি গণমাধ্যমের পাশাপাশি গণপরিবহনে নিয়োজিত যানবাহন, ব্যক্তিগত গাড়িতে তার তেলাওয়াত শোনা যায়। সুদান ছাড়াও অন্যান্য দেশের বিপনিবিতানগুলোতে প্রতিধ্বনিত হয় তার তেলাওয়াত।
[caption id="" align="aligncenter" width="476"] নামাজে তেলাওয়াত করছেন শায়খ নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক। ছবি: উইকিপিডিয়া[/caption]
নিখুঁত উচ্চারণে হৃদয়গ্রাহী তেলাওয়াতের কারণে সুদানের বাসিন্দা হলেও কোরআন প্রেমিকরা তাকে মনে করতেন ঘরের কাছের মানুষ হিসেবে। সুদানের রাজধানী খার্তুমের মসজিদে তার পেছনে নামাজ পড়তে ভিড় করতেন প্রচুর মুসল্লি। অনেকে শুধু তার তেলাওয়াত শোনার জন্য পুরো রমজান মাস খার্তুমে কাটিয়ে দিতেন।
বিশ্ববিখ্যাত এই কারি গতবছরের (৬ নভেম্বর) শুক্রবার সন্ধ্যায় সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩৮ বছর। সুদানের স্থানীয় একটি প্রোগ্রাম শেষে ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। সুদানের ওমদুরমান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে উত্তর রাজ্যের ওয়াদি হালফা এলাকাতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তার সঙ্গে থাকা আরও তিনজন হাফেজে কোরআন ইন্তেকাল করেন। তারা ছিলেন- হাফেজ আলী ইয়াকুব, কারি আবদুল্লাহ আওয়াদ করিম ও মোহান্নাদ আল কিনানি।
তার মৃত্যুর পর আফ্রিকান দেশটির ধর্মমন্ত্রী নাসিরুদ্দিন মুফরেহ চরমভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি শায়খ নুরাইন ও তার সঙ্গে থাকা তিন কোরআনে হাফেজের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক জানিয়েছিলেন।
তার মৃত্যুর পর সামাজিকমাধ্যমে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো। অনেক অনুসারী নিজেদের আইডিতে তার মৃত্যুর খবর পোস্ট করে শোক জানান।
[caption id="" align="aligncenter" width="567"] নামাজের তেলাওয়াতে অজোরে কাঁদতেন শায়খ নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক। ছবি: ইউটিউব[/caption]
তার মৃত্যুতে সুদান ও অন্যান্য দেশের আলেম উলামা, মিডিয়া পেশাদার, ধর্মীয় ও প্রচারকারী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তার জীবনী আলোচনা করে শোক জানিয়েছেন।
শায়খ নূরাইন মুহাম্মদ সিদ্দিক রহ. এর ইন্তেকলের মধ্য দিয়ে ঝড়ে পড়েছে আরও একজন কুরআনের পাখি। দরদমাখা কন্ঠে তিনি আর তেলাওয়াত করবেন না পবিত্র কুরআনুল কারিম। দরদমাখা তার ভরাট কন্ঠে আর শোনা যাবে না তার হৃদয়গ্রাহী তেলাওয়াত। পবিত্র কুরআনে হাকিমের হৃদয় সিক্ত করা মধুমাখা তেলাওয়াত আর বেজে উঠবে তার কণ্ঠে।
এমডব্লিউ/