মোস্তফা ওয়াদুদ
নিউজরুম এডিটর
বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব ডা. জাকির নায়েক। তার পূর্ণ নাম জাকির আব্দুল করিম নায়েক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নিজ দেশ ছেড়ে অবস্থান করছেন পরবাসে। মালয়েশিয়ার পূত্রাজায়া থেকে প্রচার করছেন দীনের দাওয়াত। ইসলামের বাণীকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার জ্ঞানদীপ্ত বক্তৃতা ও যুক্তির সামনে অন্যান্য ধর্মের যাজক ও পুরোহিতরা বেকায়দায় থাকেন সব সময়। তাকে সমকালীন সবচেয়ে বড় ধর্মতত্ত্ববিদ বলে মনে করা হয়।
যুগে যুগে যেসব ব্যক্তি দুনিয়াজুড়ে ইসলামের খেদমতের পরিধি বিস্তৃত এবং জনমানসে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন তারা বৈরীশক্তির টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। ডা. জাকির নায়েকও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনিও পরাশক্তির হাতে ধরাশায়ী হয়েছিলেন। গত পাঁচ বছর আগে এ বিখ্যাত দায়ীকে নিয়ে গোটা দুনিয়ায় বিতর্ক শুরু হয়েছিলো।
সে সময় তাকে বের করে দেয়া হয়েছিলো জন্মভূমি ভারত থেকে। শুধু তাই নয়; অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়েছিলো তাকে। তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তার প্রতিষ্ঠিত পিস টিভির সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। যার মাধ্যমে তিনি বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন।
ডা. জাকির নায়েক একজন ভারতীয় ইসলামি চিন্তাবিদ, ধর্মপ্রচারক, বক্তা ও লেখক। তবে সালাফি মতাদর্শের অনুসারীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তি তিনি। তার কথা ও বক্তৃতার মাঝেও সালাফি মতবাদের আলোচনা বেশি শোনা যায়। তিনি মতানৈক্যপূর্ণ মাসআলায় শুধু সালাফিদের মতামত বলেই ক্ষান্ত হোন। হানাফি, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী মতামতকে সব সময় উল্লেখ করেন না। তবে কোনো কোনো মাসআলায় এর ব্যতিক্রমও হয়। সবার মতামতই উল্লেখ করেন তিনি।
গত ১ জুলাই ২০১৬ সালে বাংলাদেশের রাজধানী বারিধারা এলাকায় অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে তার ফেসবুক ফলোয়ার কিছু যুবক হামলা চালায়। সেখানে নিহত হোন কয়েকজন বিদেশী নাগরিক। এরপর থেকেই বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হতে থাকেন এ দাঈ। নিষিদ্ধ হতে থাকেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এরই সূত্র ধরে বর্তমানে তার প্রচার কার্যক্রম সরাসরি নিষিদ্ধ রয়েছে ভারত, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে।
সে হামলার পর বিশ্বব্যাপী কোনঠাসা করা হয়েছিলো তাকে। তবে পৃথিবীব্যাপী রয়েছে তার অনেক জনপ্রিয়তা। যা তাকে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারেনি। সাময়িক সময় তিনি চুপ থেকেছেন মাত্র। কিন্তু সম্প্রতি তিনি পুনরায় আবার ইসলামের দাওয়াতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার একাধিক বক্তব্য রয়েছে। তার বক্তৃতা শুনে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ইসলাম কখনো অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা সমর্থন করে না। বরং পৃথিবীতে সবচেয়ে শান্তির ধর্ম ইসলাম।
এদিকে ডা. জাকির নায়েককে ফলো করা নেটিজেনদের একটি বড় তালিকাই হলো অমুসলিম। বিভিন্ন ডিবেটে অংশ নিয়ে তিনি এ জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন।
বর্তমানে সোশ্যাল মাধ্যমে ইসলামী বক্তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়দের তালিকায় রয়েছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার ২২ মিলিয়ন (২ কোটি ২০ লাখ) ফলোয়ার রয়েছে। এর বিপরীতে কাউকেই ফলো করতে দেখা যায়নি তাকে। ইসলামপন্থী দায়ীদের মাঝে সবার আগে তার পেজই ভেরিফাইড করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া তিনি রয়েছেন ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, পিন্টারেস্ট, টাম্বলারের মতো ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সাইটগুলোতে।সম্প্রতি পিস টিভির পাশাপাশি এসব সাইটেও ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। সাইটগুলোতে তার প্রায় ১০০ মিলিয়ন ফলোয়ার (১০ কোটি) রয়েছে।
প্রতি শনিবার পিসটিভিতে সুওয়াল ও জওয়াব নামক লাইভ প্রশ্নোত্তর প্রচার করেন তিনি। ইসলামকে মোটিফাইড করে প্রচারিত তার এসব লাইভ ভিডিওগুলোর গড়প্রতি ভিউ রয়েছে প্রায় ২০ মিলিয়ন (২ কোটি)।
পিস টিভির এ লাইভটি এখন বিশ্বের ১০ টি দেশে প্রচারিত হয়। তন্মেধ্যে মালয়েশিয়ান সময়ে রাত ১১ টায়, বাংলাদেশে সময়ে রাত ৯ টায়, পাকিস্তান সময়ে রাত ৬ টায়, কাতার সময়ে সন্ধ্যা ৬ টায়, যুক্তরাজ্য সময়ে বিকাল ৪ টায়, ইন্দোনেশিয়ায় রাত ১০ টায়, ভারতের সময়ে রাত ৮ টা ৩০ মিনিট, দুবাই সময়ে সন্ধ্যা ৭ টায়, সৌদি আরবে সন্ধ্যা ৬ টায় ও যুক্তরাষ্ট্র সময়ে সকাল ১১ টায়।
তবে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে। এসব দেশগুলো থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দেখা যায় পিস টিভি। প্রতি শনিবার প্রচারিত এ লাইভ অনুষ্ঠানে ডা. জাকির নায়েকের সাথে নেটিজেনদের পাঠানো প্রশ্নের উত্তর দেন তার ছেলে শায়খ ফারিক নায়েক। পিতার পাশাপাশি তিনিও এখন বেশ জনপ্রিয়।
তাছাড়া তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষক হিসেবে জাকির নায়েকের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। ১৯৬৫ সালের ১৮ অক্টোবর ভারতের মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে তার জন্ম। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ধর্মতত্ত্বের গবেষক শায়খ আহমাদ দিদাতের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামের দাওয়াতি কাজে জড়িত হন।
১৯৯১ সালে তিনি ইসলাম প্রচারের কার্যক্রম শুরু করেন এবং ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৫ সালে পেয়েছেন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক ‘বাদশাহ ফয়সল পুরস্কার’। ২০১২ সালের মার্চ মাসে ভারতে বিহারের কিশানগঞ্জে তার এক পাবলিক লেকচারে প্রায় ১০ লাখ লোক সমবেত হয়েছিলেন।
ডা. জাকির নায়েক ইসলাম ও মহানবী সা. এর বিরুদ্ধে একশ্রেণীর ইহুদি; খ্রিষ্টান ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীর আনীত নানা অভিযোগ লেকচারের মাধ্যমে খণ্ডন করে ইসলামের সর্বজনীন আদর্শ ও কালজয়ী শিক্ষা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তার হাতে বহু অমুসলিম ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে।
তার বক্তৃতায় শ্রোতারা মনে করেন, প্রখর মনীষা, অনন্য স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি শ্রোতাদের বিমোহিত করে রাখতে পারেন।
বহু ইসলামি ধর্মপ্রচারকদের সাথে তার ভিন্নতা হল, তার বক্তৃতাগুলো পারস্পারিক আলাপচারিতা ও প্রশ্নোত্তরভিত্তিক। যা তিনি আরবি কিংবা উর্দুতে নয় বরং হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় প্রদান করেন। আর বিভিন্ন ভাষায় তার অনুবাদ করে প্রচার করা হয়। তিনি ঐতিহ্যগত আলখাল্লা বা পাঞ্জাবি পরিধান করেন না। এর বিপরীতে স্যুট-টাই পরিধান করেন তিনি।
পেশাগত জীবনে একজন ডাক্তার হলেও ১৯৯১ সাল থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ইসলাম এবং তুলনামূলক ধর্মের উপর তার বক্তৃতার বহু পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। যদিও প্রকাশ্যে তিনি ইসলামে শ্রেণী বিভাজনকে অস্বীকার করে থাকেন, তবুও অনেকে তাকে সালাফি মতাদর্শের অনুসারী বা সমর্থক বলেই মনে করেন।
এমডব্লিউ/