।।নুরুদ্দীন তাসলিম।।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শত বছর পূর্ণ হলো আজ। তাই আজকের এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য বাড়তি আবেগের।
প্রায় দুই শতাব্দীকালের ব্রিটিশ শাসনামলে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণে নিঃস্ব প্রায় বাঙালি মুসলমানকে শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাবিতে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে দেশ-জাতির উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন এর শিক্ষার্থীরা।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাবির ক্যাম্পাস- এমন শিক্ষার্থী যেমন রয়েছে এখানে। এর বিপরীতে আপাদমস্তক কওমী পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও সুনামের সাথে মেধার সাক্ষরতা রেখেছেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কওমি থেকে পড়াশোনা শুরু, পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও রেখেছেন মেধার বিশেষ সাক্ষর, বর্তমানে যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন পেশায়- এমন ৪ জনকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
মাওলানা লিয়াকত আলী: প্রথিতযশা সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ।
মাওলানা লিয়াকত আলীর জন্ম ১৯৬৫ সালের ১২ মে খুলনায়। নিজ গ্রাম গুমানতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হয় মাওলানা লিয়াকত আলীর। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন সেখানে। এরপর স্কুল ছেড়ে ভর্তি হন। গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদরাসায়। মাওলানা লিয়াকত আলী ঢাকার জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগ থেকে সমাপ্ত করে দাওরায়ে হাদিস। পাশাাপাশি এসএসসিতে যশোর বোর্ডে মেধাতালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান এবং এইচএসসিতে ঢাকা বোর্ডে ৭ম স্থান অধিকারের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় বি.এ (অনার্স) ও এম.এ (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেছেন।
বর্তমানে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তের সিনিয়র সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন পত্রিকাটির পথচলা শুরু থেকেই। এর আগে প্রায় ১০ বছর কাজ করেছেন দৈনিক মুজাদ্দিদে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি মাওলানা লিয়াকত আলী দায়িত্ব পালন করছেন মিরপুর মাদরসা দারুর রাশাদের শিক্ষা সচিব ও জামিয়া রহমানিয়া ঢাকার সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে। এছাড়া তিনি নদওয়াতুল উলামা কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ইসলামি সাহিত্য সংস্থার ঢাকা ব্যুরোর সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে কাজ করছেন।
মাওলানা লিয়াকত আলী রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। বিখ্যাত ফকিহ আবুল লাইস সমরকান্দীর রচিত বুসতানুল আরেফিন গ্রন্থটির অনুবাদ তার জীবনের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। আরবী, উর্দু ও ইংরেজি থেকে অনুবাদেও তিনি সিদ্ধহস্ত। মাওলানা লিয়াকত আলীর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের মাঝে আলোকিত ভাবনা, ইসলামের অবদান, সময়ের মূল্য ও জীবন সাধনা, খেলাফতে রাশেদা, শরহে নুখবাতুল ফিকর, দিগ্বিজয়ী মুসলিম সেনাপতি, উন্নত জীবনের পাথেয়, কওমি মাদরাসা : নেসা ও নেজাম এবং আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহের নেপথ্য কাহিনী, ফিলিস্তিন সমস্যা ও ইহুদি চক্রান্ত বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
এছাড়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মারকগ্রন্থেও তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) স্মারকগ্রন্থ, সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) স্মারকগ্রন্থ, কাজি মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী (রহ.) স্মারকগ্রন্থ এবং তাবলীগ জামাতারে বাংলাদেশের আমির মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.) স্মারকগ্রন্থ এর মাঝে অন্যতম ।
মুফতী মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক, ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়াকেই নিজের প্রধান কর্তব্য মনে করেন তিনি।
মুফতী মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী পড়াশোনার শুরু কওমি মাদ্রাসা থেকে। ময়মনসিংহের মাখযানুল উলূমে মেশকাত পড়ার সময় দাখিল পরীক্ষা দেন তিনি। মিশকাত শেষ করেন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা থেকে।মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া সাত গম্বুজ মাদরাসা থেকে দাওরা ফারেগের পর আলিম পরীক্ষা দিয়ে ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন কওমির এই মেধাবী সন্তান। এরপর ১৯৯৮ সালে (২০০০ সালে অনুষ্ঠিত) এমএ করেন।
ময়মনসিংহের মাখজানুল উলুম মাদরাসা থেকে শুরু হয় মাওলানা মুহাম্মদ গোলাম রব্বানীর শিক্ষা জীবন। এরপর রাজধানীর জামিয়া বারিধারা মাদানিয়া ও মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদ্রাসায় কওমি শিক্ষার্থী হিসেবে কাটিয়েছেন শিক্ষা জীবনের দীর্ঘ একটা কাল। জামিয়া রাহমানিয়া থেকে ফারেগের পর আরবি সাহিত্যের উপর বিশেষ পড়াশোনা করেন তিনি ভারতের লাখনৌর নদওয়াতুল উলামা উলামাতে।
কওমি পড়ুয়া মেধাবী আলেম মাওলানা মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী ঢাবিতে অনার্স ও মাস্টার্সেও রাখেন মেধার সাক্ষর। দুটোতেই প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। লাভ করেন স্বর্ণপদক। এমফিল করা অবস্থায় ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট ঢাবিতে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে সহকারী অধ্যাপক হন। ২০১০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ঢাবির উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাবির উর্দু বিভাগের অধ্যাপক।
ছাত্র জীবন থেকেই সাহিত্য ও সাংবাদিকতার সাথে জড়িত। মাসিক আদর্শ নারী, রাহমানী পয়গাম, কাবার পথে, হেরার আলো সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকা ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব উর্দু এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মুফতী মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী ব্যক্তিগত জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কওমি মাদরাসা থেকে অর্জন করা শিক্ষা ও আদর্শ লালন করেন তিনি নিজের মাঝে। মানুষের মাঝে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়াকেই নিজের প্রধান কর্তব্য মনে করেন তিনি।
মাওলানা হুমায়ুন কবির: একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, দায়ী মেজাজের আলেম।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার সালটিয়া গ্রামের সন্তান মাওলানা হুমায়ুন কবির। নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন। এরপর রাজধানীর আম্বরশাহ মাদ্রাসা থেকে হিফজুল কোরআন সম্পন্ন করেন ১৯৮৭ সালে।
তৎকালীন ইসলামী শিক্ষার অন্যতম বিদ্যাপীঠ লালবাগ জামিয়াতে এক বছর পড়াশোনার পর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুরে পড়েছেন তিনি। এখানেই কাটিয়েছেন দরসে নেজামির পুরো শিক্ষাজীবন। এখান থেকে নিয়েছেন দাওরা হাদিসের সনদ। রাহমানিয়ায় পড়া অবস্থায় তিনি দাখিল ও আলিম পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
কওমি মাদরাসার দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা আলিয়ায়। সেখান থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির উর্দু বিভাগ। এই বিভাগে তার সহপাঠী ছিলেন বর্তমানে ঢাবির উর্দু বিভাগের স্বনামধন্য প্রফেসর মাওলানা গোলাম রব্বানী।
ঢাবিতে পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনের শুরুতে তিনি সৌদি দূতাবাসে কাজ করেছিলেন ৩ বছর। এরপর ব্যক্তিগত পেশা হিসেবে বেছে নেন ব্যবসাকে। তার নিজের রয়েছে দুটি হজ ও ওমরা এজেন্সি এছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে এক্সপোর্ট ইমপোর্ট-এর ব্যবসার সাথেও জড়িত তিনি।
কওমি মাদ্রাসার পর জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও কওমি মাদ্রাসার আদর্শকে ধারণ করেন তিনি হৃদয়ে, ভালবাসেন অন্তরের অন্তস্থল থেকে। নিজের নাড়িপোতা ভূমি ময়মনসিংহে ‘দারুস সুন্নাহ’ নামে একটি কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। মাদ্রাসাটির শিক্ষার মানোন্নয়ন ও যুগোপযোগী করতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মাওলানা হুমায়ুন কবির।
তিনি মনে করেন, সমাজের পরিবর্তনে ও দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে কওমী শিক্ষার্থীদের জাগতিক বিভিন্ন বিষয়েও ব্যুৎপত্তি অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাওয়াতি কার্যক্রম ব্যাপক ও বিস্তৃত করতে বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।
মাওলানা আব্দুল কাদের: একজন শিক্ষক, হৃদয়ে ধারণ করেন কওমির আদর্শ।
মাওলানা আব্দুল কাদের। তরুণ এই আলেম ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন ২০১৪ সালে। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা আনন্দপুর ডিগ্রী কলেজে লেকচারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহি ইলমি বিদ্যাপীঠ দারুল আরকাম মাদ্রাসা থেকে। এখানেই হেফজ থেকে দাওরা পর্যন্ত ছাত্র জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। ২০০৭ সালে ফারেগ হয়েছেন এখান থেকেই।
২০০৮-২০০৯সেশনে প্রথমে চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে এরপরে ২০০৯-২০১০ সেশনে ভর্তি হন ঢাবিতে, বেছে নেন নিজের পছন্দের সাবজেক্ট ইসলামিক স্টাডিজ।
কওমি মাদ্রাসার পাশাপাশি ঢাবিতেও কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করায় ডিনস্ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন তিনি।
কর্মজীবনে তরুণ আলেম মাওলানা আব্দুল কাদের প্রথমে একটি প্রাইভেট কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর আর্মিতে রিলিজিয়াস টিচার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৪ মাস। সেখান থেকে বর্তমানে কুমিল্লা আনন্দপুর ডিগ্রী কলেজে লেকচারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মাওলানা আব্দুল কাদের হৃদয়ে ধারণ করেন তার শেকড় কওমি মাদরাসাকে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে। তিনি মনে করেন, কওমি শিক্ষার্থী মাঝে নানা প্রতিভা সুপ্ত থাকে, সুযোগও প্ল্যাটফর্মের অভাবে অনেকের প্রতিভাগুলো অপ্রকাশিত থেকে যায়। তাই দাওয়াতি কার্যক্রমকে সুগম করতে কওমি সন্তানদের বিস্তৃত প্ল্যাটফর্ম ও সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। কলেজের লেকচারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়াই জীবনের অন্যতম লক্ষ্য মাওলানা আব্দুল কাদেরের।
-কেএল