।। আলেমা সুমাইয়া ইসরাত।।
উপমহাদেশের কওমী মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই উজ্জ্বল। কওমী মাদরাসা শিক্ষার মূল উৎস হচ্ছে মহান রাব্বুল আলামিন। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রথম ওহী হলো ‘ইকরা’ তুমি পড়। এটি হেরা গুহায় রাসূল (সা.) উপর প্রথম নাজিল হয়। ইতিহাসের প্রথম মাদরাসা মক্কা নগরীর আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)-এর বাড়ি দারে আরকামে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসূল (সা.)-এর যুগে আরবের ভৌগোলিক পরিধি মাত্র কয়েকশ’ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে সীমিত ছিল।
এখানকার সভ্যতা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণও ছিল সীমিত। যখনই কোন সমস্যা দেখা দিত সাহাবায়ে কিরাম তাৎক্ষণিক ছুটে আসতেন রাসূল (সা.)-এর দরবারে। মুহূর্তের মধ্যে সমাধা হয়ে যেত। যখন হযরত উমরের খেলাফতের জামানা আসলো ইসলামের ফতুহাত বা বিজয় হতে থাকলো বিপুলভাবে। ইসলামী রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা পরিধির বিস্তার ঘটলো। মুসলমানগণ নিত্যনতুন ভূমির অধিপতি হতে লাগলো। নতুন নতুন অঞ্চলে নতুন নতুন সভ্যতার সাথে পরিচিত হতে থাকলো।
ঠিক তখনই প্রয়োজন দেখা দিল ইসলামী শিক্ষা-সভ্যতার। তাই হযরত ওমরের যুগে ইসলামী শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল। ফলে ইরাকে অনেক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এখানে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। প্রতিনিয়তই ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যেতে শুরু করল। ছাত্রসংখ্যা বেশি হওয়াতে হযরত আলী (রা.) শিক্ষক হিসেবে এখনে আগমন করেন। ইরাকের প্রায় বারো হাজার তাবেয়ী মুহাদ্দিসীন হযরত আলী (রা.)-এর নিকট থেকে শিক্ষালাভ করেন। ইরাকে তখন হাজার হাজার মুহাদ্দিস, মুফাসসিরের আবির্ভাব ঘটে।
ইরাকের কুফা নগরীতেই ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ.) শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ ধারার বিস্তার ঘটতে থাকে খেলাফতে রাশেদার যুগ পর্যন্ত। খেলাফতে রাশেদার যুগের পর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিচ্যুতি ঘটে। ফলে ধর্মীয় শিক্ষার পরিধি সীমিত হয়ে যায়। তখন মাদরাসাগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক, খানকাকেন্দ্রিক হতে থাকে। প্রায় চার শতাব্দী পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকে। ৪০১ হিজরি থেকে ধর্মীয় শিক্ষার রূপ পরিবর্তন ঘটে। জনসাধারণের সহযোগিতায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
কওমী মাদরাসার উদ্দেশ্য : কওম অর্থ জাতি, আর কওমী অর্থ জাতীয়। মাদরাসা আরবি শব্দের অর্থ বিদ্যালয়। সুতরাং কওমী মাদরাসা অর্থ জাতীয় বিদ্যালয়। কওমী মাদরাসার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন-হাদিসের প্রচার-প্রসার এবং দ্বীন ইসলামকে বিশুদ্ধরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা এবং দ্বীনের শাশ্বত শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। ইসলামী শিক্ষার সুরক্ষার সাথে সাথে নিত্যনতুন সৃষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, ফিতনা ইত্যাদি সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সতর্ক করা, তাদের হিংস্র থাবা হতে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা।
কওমী মাদরাসার বৈশিষ্ট্য : কওমী মাদরাসা ছাত্রদেরকে কুরআন-হাদিসের আলোকে জ্ঞান দান করে, ত্যাগী, পরোপকারী, সমাজসেবক, অধিক ভোগ-বিলাসে নিরুৎসাহী এবং স্বল্প উপার্জনে সন্তুষ্ট থেকে জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। এখানে দুনিয়া বিমুখতা, কষ্ট, সবর, শোকর, আত্মীয়তার বন্ধন, ন্যায়পরায়ণতা, মমত্ববোধ, উত্তম আখলাক-চরিত্রের বিষয়গুলোই শিক্ষা দেওয়া হয়। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল, হল দখল, দুর্নীতি, মিথ্যা, প্রতারণা, ব্যভিচার, অপকর্ম, চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানী, অপসংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে কোন রকমের সম্পর্ক রাখে না। এমনকি থানাগুলোতেও সন্ত্রাসীদের তালিকায় কোন কওমী মাদরাসার শিক্ষক বা ছাত্র জড়িত থাকার প্রমাণ মিলে না। দেশপ্রেমিক ঈমানদার খাঁটি মানুষ তৈরির কারখানাই হলো কওমী মাদরাসা।
কওমী মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা : শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। শিক্ষা জাতির উন্নতির সোপান। শিক্ষা জাতিকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পথ নির্দেশ করে। শিক্ষা মানুষকে সুন্দর, পরিমার্জিত ও আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে মানবরচিত পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা কখনো মানবজীবনের সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত কুরআন ও নবী করীম (সা.)-এর সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত সফলতা ও কামিয়াবী বয়ে আনতে পারে। এ জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা ফরজ করে দিয়েছেন। এছাড়াও ইসলামী শিক্ষা হচ্ছে শাশ্বত শিক্ষা।
এ শিক্ষাই মানুষকে নৈতিকতার উচ্চাসনে সমাসীন করতে পারে। আর কওমী মাদরাসা হচ্ছে এই ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ও সত্যিকারের ধারক-বাহক। এজন্য কওমী মাদরাসা হতে শিক্ষাপ্রাপ্তরা সমগ্র দুনিয়াতে ইসলাম ও মানবতার খিদমতে নিয়োজিত। দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামী মূল্যবোধের হেফাজতের লক্ষ্যে তারা খোদায়ী মদদে বুকটান করে এগিয়ে আসেন। তবে হ্যাঁ জাগতিক জীবন পরিচালনার জন্য সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখযোগ্য।এজন্যে কুরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞানের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান অর্জন করে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা একান্ত কর্তব্য। তাই কওমী মাদরাসা ও কওমী মাদারাসাভিত্তিক সঠিক ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
দরসে নিজামী প্রতিষ্ঠা : ১১০০ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকহারে থাকলেও তা কোনো সিলেবাসভিত্তিক বা কারিকুলামের আলোকে ছিল না। কিছু ১১০৫ হিজরিতে মোল্লা নিজামুদ্দীন সাহলাভী ইসলামী শিক্ষাকে ঢেলে সাজান। তিনিই দরসে নিজামী মাদরাসা শিক্ষা পদ্ধতির চালু করেন। তিনি ছিলেন একাধারে দ্বীনের সুদক্ষ আলিম, ফিকাহ শাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, ভাষ্যকার এবং একজন শিক্ষাবিদ। তিনি উত্তর ভারতের সাহালী শহরে ১০৮৮/৮৯ মোতাবেক ১৬৭৭-৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হিরাতের প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ শায়খ আব্দুল্লাহ আনসারী ছিল তাঁর পূর্বপুরুষ।
শায়খ নিজামুদ্দীন সাহালীতে ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের সূচনা করেন। তারই প্রপৌত্র শায়খ হাফিজের জ্ঞানসাধনায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট আকবর তাকে ঐ এলাকায় ভালো একটি জায়গীর প্রদানের নির্দেশ দেন। ফলে শায়খ ও তাঁর পুত্রগণ নিশ্চিন্তে তালীমের কাজে মগ্ন থাকেন। ছাত্রদের খাদ্য ও বাসস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাও করেন। ইসলামের শত্রুরা ১১০৩ হিজরি মোতাবেক ১৬৯১ সালে মোল্লা নিজামুদ্দীনের পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীনকে শহীদ করে তার শিক্ষা উপকরণসমূহ জ্বালিয়ে দেন। ফলে মোল্লা নিজামুদ্দীনসহ চার ভাই লাখনৌ চলে যান। সম্রাট আওরঙ্গজেব এই পরিবারের শিক্ষার অবদানের কথা বিবেচনা করে লাখনৌর প্রসিদ্ধ ফিরিঙ্গী মহলে এক সরকারি আদেশবলে জায়গীর দান করেন।
মোল্লা নিজামুদ্দীন এখানে দ্বীনি শিক্ষার কাজ চালিয়ে যান, এমন সময় এটাই মাদরাসায়ে নিজামিয়া নামে সুপরিচিতি লাভ করে। তিনি গঠনমূলকভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে প্রায় ১১টি বিষয়ের সমন্বিত একটি সিলেবাস প্রণয়ন করেন। ইতিহাসে এটাই দরসে নিজামীয়া পদ্ধতি নামে পরিচিত। ১১০৭ হিজরিতে গাজীউদ্দীন খান আজমীর গেটস্থ একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে দিল্লী কলেজ নামে প্রসিদ্ধ। এখানের ছাত্রদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো মাওলানা কাসেম নানুতুবী, মাওলানা রশিদ আহমাদ গাংগুহী (রহ.)। কালক্রমে মাদরাসাটির শিক্ষা কার্যক্রমের বিকৃতি ঘটে এবং কলেজে পরিণত হয়।
উপমহাদেশে কওমী মাদরাসা : ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বার্মা, সৌদি আরব তথা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ন্যায় বাংলাদেশেও অনেক পূর্ব থেকে অসংখ্য কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সিপাহসালার ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বঙ্গদেশ বিজয় করার পর রংপুরে তিনি একটি কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শাহ তুরকান শহিদ বগুড়া অঞ্চলে, শাহ তাকি উদ্দীন আরাবী (রহ.) রাজশাহীতে এবং ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.) তদানীন্তন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে একটি উচ্চমানের মাদরাসা স্থাপন করেন।
যুগের বহু মসজিদ-মাদরাসা আজ আমাদের সামনে নেই; কালের বিবর্তনে আজ তা হারিয়ে গেছে। সুলতানী আমলে বহু মসজিদ মাদরাসা সরকারি খরচে পরিচালিত হতো। ইংরেজরা এদেশের স্বাধীনতা হরণ করার পর তা বন্ধ করে দেয়। ঐতিহাসিকদের মতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমণের পূর্বে প্রায় ৮০ হাজার মাদরাসা ছিল। দি ইন্ডিয়ান মুসলমান গ্রন্থের লেখক ডাব্লিউ-ডাব্লিউ হান্টার লিখেছেন যে, মুসলিম শাসনামলে প্রতি আশি জনের জন্য একটি মাদরাসা ছিল।
১২২৭ খ্রি. সুলতান গিয়াস উদ্দিন রাজধানী লক্ষণাত্যে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার নবাব শায়েস্তা খানের আমলেও লালবাগ কেল্লার নিকট মাদরাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। উইলিয়াম হান্টার তার গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেছেন, মুসলিম শাসক আলিবর্দি খানের আমলে বহু মসজিদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। মুসলিম শাসক ও জমিদারদের অর্থে প্রায় সতের হাজার মাদরাসা পরিচালিত হতো। দীর্ঘকাল এভাবে মাদরাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটতে থাকে। মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্রুত বেগে বৃদ্ধিলাভ করতে থাকে। এসব দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের ওপর কু-নজর পড়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের।
এক সময় তারা দখল করে নেয় এই উপমহাদেশের মুসলিম স্বাধীনতা। প্রায় দু’শ’ বছর গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখে এদেশের মানুষকে। ইংরেজদের জুলুম-নির্যাতন স্বকীয়তা হরণ রোষানলের সৃষ্টি হয়। উপরন্তু উলামায়ে কিরাম তাদের হীন উদ্দেশ্যের মুখোশ উন্মোচন করত তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতওয়া দেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচ- লড়াই হতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের সাথে পলাশীর ময়দানে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন এবং মুসলিম নেতাদের শাহাদাতের মধ্যদিয়ে বাহ্যিক দিক থেকে পরাজয়বরণ করেন।
ফলে এদেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উৎস জায়গীর ও ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দিলে মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও ইসলামী শিক্ষা থেমে থাকেনি। সরকারি বন্দোবস্ত না হওয়া সত্ত্বেও মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পর ইসলামী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এভাবে প্রায় দশটি বছর কেটে যায়। মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে অমানিশার অন্ধকার নেমে আসে। জাতি পথ হারা, উদভ্রান্তের মতো হতবিহবল হয়ে পড়ে।
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা : ১৮৬৬ সালে হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.) দেওবন্দের দেওয়ান মহল্লায় স্বীয় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। বাড়ি সংলগ্ন সাত্তা মসজিদের ইমাম হযরত মাওলানা হাজী আবিদ হোসাইন সাহেবের সাথে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হওয়ার পর সেখানেই একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মিরাট থেকে মোল্লা মাহমুদ সাহেবকে ডেকে এনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করে দেওবন্দে পাঠিয়ে দেন। অবশেষে ১৮৬৬ সালের ৩০ মে বুধবার সাত্তা মসজিদের বারান্দায় ডালিম গাছের নিচে ঐতিহাসিক দীনি দরসেগাহ দারুল উলুমের উদ্বোধন হয়।
মোল্লা মাহমুদ সর্বপ্রথম ছবক দান করেন সর্বপ্রথম ছাত্র মাহমুদকে। যিনি পরবর্তীতে শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। কি চমৎকার কাকতালীয় ব্যাপার, ছাত্রও মাহমুদ, উস্তাদের নামও মোল্লা মাহমুদ। আরবী মাহমুদ শব্দের অর্থ প্রশংসিত। আল্লাহপাক মানুষের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। তখন এই মাদরাসাটি দেওবন্দ আরবী মাদরাসা নামে পরিচিত ছিল। ১২৯৬ হিজরিতে সদরুল মুদাররিসীন হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবী (রহ.)-এর প্রস্তাবে মাদরাসার নামকরণ করা হয় “দারুল উলুম দেওবন্দ”।
কওমী মাদরাসার অবদান : কওমী মাদরাসা “সিরাতে মুস্তাকীম” তথা সঠিক সরল পথের সংরক্ষক ও অতন্দ্র প্রহরী। যা রাসূল (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবে‘ঈন, তাবে‘ঈন থেকে তাবে তাবে‘ঈন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে। অতঃপর আইম্মায়ে মুজতাহিদীন থেকে প্রত্যক যুগেই এ আমানত উম্মতের নির্বাচিত মনীষীগণের মাধ্যমে পৌঁছেছে। নিঃসন্দেহে তা সামষ্টিকভাবে অক্ষত। এইভাবে দ্বীনের স্থায়ী সংরক্ষণ হয়ে আসছে।
আল্লাহ তায়ালা কওমী আলেম-ওলামা দ্বারা বিগত দিনগুলোতে দেশ-জাতি ও দ্বীনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন-তা দৃষ্টান্তহীন। হেদায়াতের এমন কোন পথ নেই, যাতে কওমী আলেম দ্বারা পথনির্দেশিকা স্থাপন করা হয়নি। বিশ্ব পরিস্থিতিতে দ্বীনের অপব্যাখ্যা, অপপ্রচার সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সচেতন করে তোলেন কওমী ওলামায়ে কেরাম। তারা ধর্মহীনতা, বদদ্বীনি, নাস্তিকতার প্লাবনে ভেসে যাওয়া মুসলমানদের পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
তারা বর্তমান সময়ে ইসলাম এবং মুসলিম জাতির হেফাযতের গুরু দায়িত্ব পালন করছেন। দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতি সন্তান হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) প্রতিষ্ঠিত তাবলীগ জামায়াত বিশ্বব্যাপী দাওয়াতে দ্বীনের মিশন চালু রেখেছেন। কওমী ওলামায়ে কেরাম হাদিস, ফিকাহ তাফসীরসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের সহায়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। পাশাপাশি কুরআনের অপব্যাখ্যা, বিকৃত ব্যাখ্যা কারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে এ সম্পর্কে সচেতন করেন। দেশ ও জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন।
ভারত বর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জিহাদের ফতোয়া প্রদান করেন শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্বেও ছিলেন ওলামায়ে কেরাম। কওমী ওলামায়ে কেরামের কর্ম তৎপরতার কেবলমাত্র শিক্ষা-সংস্কৃতির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন। এদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক সুস্থ চিন্তাধারার বিকাশ, দ্বীনের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ময়দানে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হয় কওমী মাদরাসার সূর্য সন্তানদের মাধ্যমে।
-কেএল