গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী
এইতো সেদিন। আপনার প্রিয় প্রতিষ্ঠানের স্মৃতিময় আঙিনায় দাঁড়িয়ে। আপনার সাথে অনেক কথা হলো। জীবন পথের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দিলেন। বাতলে দিলেন সত্যের ওপর অবিচল থাকার দীপ্ত শিক্ষা। শৈশব এবং কৈশোরে আপনার সান্নিধ্য পেয়েছি। পেয়েছি জীবন পথের অনন্য দিশা। ছাত্র জীবন ও কর্ম জীবনের নানা সময়ে আপনার আন্তরিক সাহচর্য লাভ করে ধন্য হয়েছি। আপনার সুযোগ্য সন্তানদের ভালোবাসায় বারবার পুলকিত হয়েছি। গর্ববোধ করেছি।
যখন আপনার সুযোগ্য সন্তান, প্রিয় মানুষ, মাওলানা নোমান ভাই ফোন করে আপনার মৃত্যু সংবাদটি যখন জানালেন, কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলাম। চোখগুলো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। বুকটা ভরে গেলো শোক ও কান্নায়। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলাম ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হৃদয়ের স্মৃতিপটে বারবারই ভেসে উঠছিলো আপনার স্মৃতিগুলো।
আপনি যখন জামিয়া রাহমানিয়ায় আসতেন, তখন আমি ছাত্র। মেশকাত বা দাওরায়ে হাদিস পড়ি। অসংখ্য মানুষের ভেতর থেকে আমাকে নাম নিয়ে খুঁজছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে, রুম ভর্তি মানুষদের মাঝে, হাতে ধরে আপনার পাশে বসার সৌভাগ্যে আমার ধন্য করতেন। এসব আজ কেবল স্মৃতি। আপনার সেই বরকতের হাত দুটি স্পর্শ করার সুযোগ হারালাম। চিরদিনের জন্য। আপনি এখন আল্লাহর আমানতে।
শেষবার যেদিন নাজিরহাট মাদ্রাসার খোলা মাঠে, শীতের মধ্য দুপুরে, আপনার সাথে সাক্ষাৎ হলো।সেদিনের সেই সাক্ষাতে বুঝতে পেরেছিলাম, আপনার জীবন প্রদীপ হয়তো অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে আসছে। আপনি বলেছিলেন, আপনি না থাকলেও যেন আপনার মাদ্রাসার প্রতি থাকে আমাদের অপার ভালোবাসা।
এর কদিন পর, আপনার প্রিয় প্রতিষ্ঠানের মাহফিলে যাবার সুযোগ হলো। আল্লাহর অপার অনুগ্রহে একাধারে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় কথা বলার তৌফিক হলো। আপনার স্বপ্নের সেই বাগানে আলোচনার প্রারম্ভিকতা ও উপসংহার ছিলো আপনাকে কেন্দ্র করে। আপনার স্মৃতি জড়িয়ে। আজ আমরা নিঃস্ব। আপনাকে হারিয়ে। আপনার মত এক আপন অভিভাবক হারিয়ে। তুলাবা, উলামা ও দ্বীনি মাদারিসের জন্য এক সমুদ্রসম হৃদয় হারিয়ে।
মধ্যরাতে। রাত দুটোর পর কথা হলো স্নেহের প্রিয় ভাই, মাওলানা আছেম এর সাথে। আছেম ভাই একসঙ্গে আমার স্নেহের এবং ভালোবাসার মানুষ। আমার মোবাইলে তার নামটি খুব সুন্দর করে লেখা। মাওলানা আছেম বিন হাফেজ কাশেম। শেষ সময়ে হযরতের শারীরিক খোঁজখবর আছেম ভাই থেকেই পেতাম। হযরতের শরীর একটু খারাপ হলেই তিনি ফোন করতেন। দোয়া চাইতেন। আজকেও আছেম ভাই দোয়া চাইলেন। তার অশ্রুভেজা কান্নার শব্দগুলো আমার হৃদয় একেকটি বেদনার বৃষ্টি হিসেবে ঝরে পড়েছে।
সদ্য বাবা হারানো একজন সন্তানের কান্না কতটা ভারী হতে পারে, এটা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। আমিও জেনেছিলাম, যেদিন আমার আব্বাজান দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছিলেন। আগে থেকে নির্ধারিত একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠান থাকায় জানাজায় শরিক হতে পারছি না। আমি ঢাকায় ছটফট করছি, আর মনটা পড়ে আছে ফটিকছড়ির তালিমুদ্দিন মাদ্রাসার শোকাহত মানুষের সেই জনসমুদ্রে। যেখানে কোন আওয়াজ নেই। কোনো বিলাপ নেই। আছে কেবল হৃদয় ভাঙ্গা কান্নার নিঃশব্দ ঝড়। আকাশের পানে শোকাহত মানুষের মাগফেরাতের আকুতি।
হে প্রিয় উস্তায, হে প্রিয় শায়েখ, হে উস্তাযুল আসাতিযা আল্লাহ তাআলা আপনার কবরকে রহমের শিশিরে ভেজা রাখুন। আকাশের অপার রহমত বর্ষিত হোক আপনার ওপর। প্রতিদিন। প্রতিক্ষণ। মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে আপনার জান্নাতের উঁচু মাকাম প্রত্যাশা করছি।
লেখক: মিডিয়া আলোচক। খতিব, মোহাম্মদি হাউসিং সোসাইটি জামে মসজিদ, ঢাকা
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম