ফরহাদ খান নাঈম।।
নরনারীর বিবাহবন্ধন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক বিশেষ অনুগ্রহ। পবিত্র কোরআনে এটিকে আল্লাহর একটি বিশেষ নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর এক নিদর্শন (হচ্ছে): তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয় চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন আছে। সূরা রুম: আয়াত ২১।
আল্লাহ তায়ালা অভিভাবকদেরকে তাদের অধীনস্থ নারী-পুরুষকে সময়মতো বিবাহ দিয়ে দিতে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আর তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন তাদের বিয়ে সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্ৰস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। সূরা নূর: আয়াত ৩২।
ইসলাম বিবাহকে আবশ্যক করেছে। আর ইসলামে যেকোনো কাজে এমনি এমনি আদেশ দেওয়া হয়না। তেমনি নরনারীর বিবাহবন্ধনের পেছনেও কিছু তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। যেমন- উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি করা; কেয়ামতের ময়দানে অন্য নবীগণের আ. সামনে রাসুলুল্লাহ সা. নিজ উম্মতের সংখ্যাধিক্য নিয়ে গর্ব করবেন, নারী-পুরুষ উভয়কে হারাম কাজ থেকে নিরাপদ রাখা। এছাড়াও বিবাহের আরও বহু উপকারিতা রয়েছে।
কিন্তু কিছু কিছু অভিভাবক নিজেরাই অধীনস্থদের বিবাহবন্ধনে বাধা সৃষ্টি করে। এসব অযাচিত বাধার মধ্যে সাধ্যাতীতভাবে ছেলের উপর মোহরানা চাপিয়ে দেওয়া অন্যতম। আমাদের সমাজে ছেলের উপর তার সাধ্যাতীত মোহরানা চাপিয়ে দেওয়া একটি প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। কখনো কখনো এমনও হয় মোহরানার টাকা পরিশোধ করতে না পারার ভয়ে অনেক যুবক বিবাহ থেকে পিছু হটে।
মোহর হচ্ছে স্বামীর সাধ্য অনুযায়ী তার স্ত্রীকে দেওয়া একটি নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ। এটি স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর মনের সন্তোষের সাথে প্রদান কর; অতঃপর সস্তুষ্ট চিত্তে তারা মাহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। সূরা নিসা: আয়াত ৪।
তবে এর মানে এই নয় যে, নারী অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হওয়া কোনো পণ্য; বরং এই মোহরানা নারীর সম্মানের প্রতীক। ইসলাম পুরুষের জন্য মোহরানা আদায় করাকে আবশ্যক করার মাধ্যমে তাকে মনে করিয়ে দেয় যে, তাকে বাকিটা জীবনও তার স্ত্রীর সবধরনের ভরণপোষণ বহন করতে হবে।
শরীয়াত মোহরানার কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করেনি। তবে ইসলাম মোহরানার পরিমাণকে যথাসম্ভব কমিয়ে স্বামীর সাধ্যের মধ্যে রাখতে বলেছে।
নবীজি সা. বলেছেন, সেই বিবাহ সর্বোত্তম যেটা সবচেয়ে সহজে অনুষ্ঠিত হয়। ইবনে হিব্বান: ৩৩০০। তিনি সা. আরও বলেন, সবচেয়ে সাধারণ ও সহজে আদায়যোগ্য পরিমাণ মোহরানা সর্বোত্তম। বায়হাকি: ৩২৭৯। নবীজি সা. বিবাহপ্রার্থী একজন সাহাবিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, তুমি তোমার স্ত্রীর মোহরানা আদায় করো, এমনকি যদিও তা একটি লোহার আংটি দিয়ে হয়। বুখারি ও মুসলিম।
রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর নিজ কন্যা ফাতিমা রা. এর বিবাহে মোহর নির্ধারণ করার মাধ্যমে মোহরানা সহজীকরণের সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যখন আলী রা. ফাতিমা রা. কে বিবাহ করেন তখন রাসুলুল্লাহ সা. তাঁকে বললেন, তুমি ফাতিমাকে (মোহরানা স্বরূপ) কিছু দাও। আলী রা. বললেন, আমার নিকট কিছু নেই। নবী করীম সা. তাকে বললেন, তোমার হুতামী বর্মটি কোথায়? ওটাই তুমি তোমার মোহরানা হিসেবে আদায় করে দাও। আবু দাউদ: ২১২৫।
এই ছিলো জান্নাতী রমনীদের নেত্রী রাসুলুল্লাহ সা. এর কন্যা ফাতিমা রা. এর মোহর। সাহাবি উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, সাবধান! তোমরা নারীদের মোহর বাড়িয়ো না। কেননা, তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং পরকালে আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকওয়ার বিষয় হতো তবে তোমাদের অপেক্ষা সেই ব্যাপারে আল্লাহর নবী অধিক উপযোগী ছিলেন, কিন্তু দুজাহানের নবী (সা.) বারো উকিয়ার বেশি দিয়ে তাঁর কোনো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।’ আবু দাউদ: ২১০৬
বারো উকিয়া হলো ৪৮০ দিরহামের সমমূল্য পরিমাণ যা প্রায় ১৩৫ রৌপ্য মুদ্রার সমান। এটিই ছিলো নবী সা. এর সকল স্ত্রী ও কন্যার মোহর।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া মাজমুঊল ফাতাওয়া (৩২/১৯৪) এ বলেছেন, যারা মোহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নবীজি সা. প্রদত্ত পরিমাণকে টপকিয়ে আরও বেশি নির্ধারণ করতে চায়, তারা আসলে মূর্খতার মধ্যে রয়েছে। কেননা নবীজি সা. প্রদত্ত মোহরানার পরিমাণই হলো সর্বোত্তম; তবে যাদের এই সামর্থ্যটুকুও নেই তারা আরও কম দিতে পারবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মোহরানার আসলে কোনো সর্বোচ্চ কিংবা সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারিত নেই। প্রত্যেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী মোহরানা আদায় করবে; কেননা স্বামীর সাধ্যাতীত মোহরানা ধার্য করা শরীয়াতে নিষেধ করা হয়েছে।
-এটি